পেয়ারাচাষি আসলাম উদ্দিন

বরেন্দ্রখ্যাত রাজশাহী অঞ্চলের মাটির প্রকৃতি লাল। তবু খরাপ্রবণ এই অঞ্চলজুড়ে গত এক দশকে ফসলের বৈচিত্র্য বেড়েছে। শষ্যভান্ডারখ্যাত বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে এখন আম, পেয়ারা, কুল এমনকি মাল্টারও চাষ হচ্ছে, বেড়ে চলেছে উৎপাদন।

অম্লীয় এই মাটিতে পেয়ারা চাষের পরিধি বাড়লেও চাষিদের দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে ছত্রাকের আক্রমণজনিত ‘উইল্ট’। এই রোগের আক্রমণে গাছ ধীরে ধীরে শুকিয়ে মারা যাচ্ছে। একটি-দুটি করে গাছ মরে উজাড় হচ্ছে পুরো বাগান। ফলে বাগান করতে গিয়ে খরচ বাড়ছে বাণিজ্যিক পেয়ারাচাষিদের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত অম্লীয় মাটিতে উইল্টের প্রকোপ বেশি। এটি নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। কৃষি দপ্তর সেটি নিয়ন্ত্রণে নানা কলাকৌশল প্রয়োগ করছে। তবে উইল্ট প্রতিরোধী জাতে অঙ্গজ উপায়ে জোড়কলমের মাধ্যমে উইল্টিং প্রতিরোধী নতুন জাত তৈরি করা সম্ভব। 

পুঠিয়া উপজেলার জিউপাড়া ইউনিয়নের সরিষাবাড়ি গায়েনপাড়ার বাসিন্দা আসলাম উদ্দিন প্রায় এক দশক ধরে পেয়ারা চাষ করেন। স্বাবলম্বী এই পেয়ারাচাষি জানান, তার চার বিঘা জমিতে পুরোনো পেয়ারা বাগান রয়েছে। বাগানে প্রতিটি গাছের বয়স হয়েছে তিন বছর। এরই মধ্যে একটি-দুটি করে গাছ মরতে শুরু করেছে। কী কারণে এমন হচ্ছে, তা তিনি জানেন না।

আসলাম জানান, পুরোনো বাগানে এরই মধ্যে লাভ উঠে এসেছে। গত ছয় মাসে তার বাগানে খরচ দেড় লাখ টাকা। কিন্তু পেয়ারা বিক্রি হয়েছে চার লাখ টাকার। এতে লাভ হয়েছে আড়াই লাখ টাকার মতো। লাভজনক হওয়ায় আরও দুই বিঘা জমিতে নতুন করে পেয়ারা বাগান করেছেন। আগামী বছর পেয়ারা বাগান বড় করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। পেয়ারা বাগান চার থেকে পাঁচ বছর রক্ষা করতে পারলে লোকসান থাকবে না।

বাগান ঘুরে দেখছেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা

আসলাম উদ্দিনের বাগান ঘুরে দেখেছেন রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জি এম মোরশেদুল বারী ডলার। বরেন্দ্র অঞ্চলে পেয়ারা চাষের সমস্যা নিয়ে সেখানেই কথা হয় এই গবেষকের সঙ্গে। তিনি বলেন, পেয়ারায় এখন দুটি প্রধান রোগ দেখা যাচ্ছে। যার মধ্যে একটি উইল্টিং, অন্যটি এনথ্রাকনোজ। ডাইথিন এম ৪৫ জাতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে করে এনথ্রাকনোজ মোটামুটিভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। আর উইল্টিং বা ডাইব্যাক নিয়ন্ত্রণের জন্য মাটি শোধন করা জরুরি। পাশাপাশি সালকক্স অথবা বাড়িতে তৈরি করা বর্দো মিক্সার বা বর্দো পেস্ট ব্যবহার করতে হবে।

উইল্ট রোগের কারণ ও লক্ষণ
জি এম মোরশেদুল বারী বলেন, মূলত মাটিতে থাকা ফিউজারিয়াম ছত্রাক গাছের একটি নির্দিষ্ট অংশে গিয়ে আক্রমণ করে। ফলে আক্রমণের ওপরের অংশ পুষ্টি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমে গাছের একটি ডগা শুকিয়ে যায়। এরপর একটি ডালের সব পাতা এবং ডগা ওপর থেকে প্রথমে হলুদ হয়ে শুকিয়ে মারা যায়। আস্তে আস্তে গাছের একটি পাশ এবং ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ গাছ ঢলে পড়ে। অম্লীয় মাটিতে এই রোগের আক্রমণ বেশি হতে দেখা যায়।

যেভাবে উইল্টিং প্রতিরোধ
কীটতত্ত্ববিদ মোরশেদুল বারী বলেন, উইল্টিং যে ডালে শুরু হচ্ছে, সেটির মরে যাওয়া অংশের ২ ইঞ্চি নিচে পর্যন্ত কেটে দিতে হবে। এরপর খণ্ডিত অংশে বর্দো পেস্ট লাগিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া দুই-তিনবার ডাইথেন এম ৪৫ (ব্লেটক্স) অথবা বর্দো মিশ্রণ (১ শতাংশ) স্প্রে করতে হবে। পাশাপাশি গাছকে সুষম খাবার দিলে এবং নিয়মিত পরিচর্যা করলে কৃষক অন্তত পাঁচ বছর পেয়ারা বাগান রাখতে পারবেন।

পেয়ারা পাতায় উইল্ট ছত্রাকের আক্রমণ

যেভাবে তৈরি করবেন বর্দো মিকশ্চার
ছত্রাকজনিত রোগ দমনে বিশেষভাবে কার্যকরী চুন ও তুঁতে দিয়ে তৈরি বর্দো মিকশ্চার। এটি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ও সহজলভ্য। এক কেজি তুঁতে বা কপার সালফেট এবং দুই কেজি চুন ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে তৈরি করা যায় ১ শতাংশ বর্দো মিকশ্চার।

প্রথম আলাদা দুটি মাটির পাত্রে পাঁচ লিটার করে পানি নিতে হবে। এরপর একটি পাত্রে ১০০ গ্রাম গুঁড়া তুঁতে এবং আরেকটি পাত্রে ১০০ গ্রাম গুঁড়া চুন দিতে হবে। বাশের কাঁঠি দিয়ে আলাদা দুটি মিশ্রণ তৈরি করে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এরপর আরেকটি বড় মাটির পাত্রে মিশ্রণ দুটি একত্র করে ভালোভাবে মিশিয়ে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে বর্দো মিক্সার।

মিশ্রিত দ্রবণের রং গাড় নীল হলে বুঝতে হবে সঠিক হয়েছে। দ্রবণ সবুজ বা সাদা হলে যথাক্রমে তুঁতে ও চুন বেশি হয়েছে। পানি দিয়ে মাত্রা ঠিক করে নিতে হবে। দ্রবণ প্রস্তুত করার দুই-তিন ঘণ্টার মধ্য স্প্রে করা দরকার। মনে রাখতে হবে, এটা একটি বিষ। ফলে মিশ্রণ তৈরির পর হাত ভালোভাবে ধুয়ে নেওয়া জরুরি।

উইল্টিং রোধের অন্য কৌশল
চাষ হওয়া জনপ্রিয় পেয়ারার জাতগুলো বেশি ফলন দিলেও উইল্টিং প্রতিরোধী নয়। জোড়কলমের মাধ্যমে উইল্টিং প্রতিরোধী গাছ তৈরি করা যায়। এমনটিই জানিয়েছেন বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টারের পরিচালক ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম এ রহিম। তিনি বলেন, পলি পেয়ারা, আঙুর পেয়ারা ও স্ট্রবেরি পেয়ারা জাতের চারা আদিজোড় হিসেবে ব্যবহার করে পেয়ারার উইল্ট রোগ এড়ানো সম্ভব।

উইল্টিং সংবেদনশীল জাত কাজি ও স্বরূপকাঠি এবং প্রতিরোধী জাত পলি পেয়ারাতে উইল্টিং রোগের বাহক ফিউজারিয়াম দেওয়া হয়। এ ছাড়া ভিনিয়ার কলম এবং ক্লেফট গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমেও উইল্ট প্রতিরোধী পেয়ারার গ্রাফট উৎপাদন করা যেতে পারে। 

তবে উইল্টিং ঠেকাতে পলি পেয়ারার সঙ্গে গ্রাফটিং ফলন কমিয়ে দিতে পারে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শামছুল হক। তিনি বলেন, যে প্রযুক্তি ফলন কমিয়ে দেবে, কৃষক সেই প্রযুক্তি নেবে না। এ জন্য এই প্রযুক্তি সেভাবে আর এগোচ্ছে না।

উইল্ট রোগে মারা যাওয়া গাছ

তবে আশার কথা, যে বছর পেয়ারার চারা লাগানো হয়, সে বছরই ফলন আসে। তার পরের বছর পেয়ারা আসে বেশ। আর দুই-তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ফলন চলে আসে। আর চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই লাভবান হচ্ছেন কৃষক। ফলে এ নিয়ে কৃষক চিন্তিত নন। 

তিনি আরও বলেন, প্রায় ১৫ বছর ধরে জেলার গোদাগাড়ী ও পুঠিয়ায় পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। দিনে দিনে জেলার অন্যান্য উপজেলায় পেয়ারা চাষের পরিধি বাড়ছে। বিশেষ করে থাই পেয়ারার বিভিন্ন জাতে তিন থেকে চার বছর পর উল্টিং হচ্ছে। এতে বাগান নষ্ট হচ্ছে। ফলে পুরোনো বাগান তুলে দিয়ে কৃষক চলে যাচ্ছেন অন্য ফসলে। বিষয়টি আমরা কৃষি গবেষণা বিভাগকে জানিয়েছি।

রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি দফতর জানিয়েছে, ২০১৯-২০ কৃষিবর্ষে রাজশাহী কৃষি অঞ্চলে পেয়ারার আবাদ হয়েছে চার হাজার ৭১৭ হেক্টর জমিতে। হেক্টরপ্রতি ১৭ দশমিক ৮০ টন হারে পেয়ারার উৎপাদন হয়েছে ৮৩ হাজার ৯৬৫ টন। ২০১৮-১৯ কৃষিবর্ষে এই অঞ্চলে ৫ হাজার ৭৭১ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছিল পেয়ারার। ১৯ দশমিক ৯৩ টন হারে সেবার উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬২৩ টন।

এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পেয়ারা বাগান রয়েছে রাজশাহীতে, ২ হাজার ৯০৪ হেক্টর। এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১ হাজার ৭৬ হেক্টর, নাটোরে ৩৮০ হেক্টর এবং নওগাঁয় ৩৫৭ হেক্টর পেয়ারা বাগান রয়েছে। এই বছর পেয়ারার ফলন সবেচেয় বেশি রাজশাহীতে, হেক্টরপ্রতি ২৩ দশমিক ৬৬ টন। এ ছাড়া নাটোরে ১৫ দশমিক ৩০ টন, নওগাঁয় ৭ দশমিক ৪৭ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৬ দশমিক ৮৩ টন পেয়ারার ফল পেয়েছেন চাষিরা।

এর আগে ২০১৮-১৯ মৌসুমে এ অঞ্চলে ৫ হাজার ৭৭১ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছিল পেয়ারার। ১৯ দশমিক ৯৩ টন হারে উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬২৩ টন। লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছরই বাড়ছে পেয়ারার চাষ।

এনএ