সুইস ব্যাংক থেকে টাকা এনে দেওয়া হবে সুদমুক্ত ঋণ। এমন প্রলোভনে কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা থেকে প্রায় লক্ষাধিক জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য (এনআইডি কার্ডের ফটোকপি) হাতিয়ে নিচ্ছে অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ নামে কথিত একটি এনজিও।

জেলার বিভিন্ন উপজেলার গ্রামে ও পাড়া মহল্লায় ছড়িয়ে পড়েছে চক্রটি। গ্রামের সাধারণ মানুষের সরলতাকে পুঁজি করে আইডি কার্ডের পাশাপাশি হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থও। এক্ষেত্রে গ্রামের নারীদেরকে টার্গেট করেছে চক্রটি।

জানা গেছে, চক্রটি বেশ কয়েকটি এলাকায় গিয়ে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে সাধারণ মানুষকে জড়ো করে। পরে সেখান থেকে শিক্ষিত ও স্মার্ট দেখে উপজেলা ভিক্তিক বিশেষ করে নারীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আর, সাধারণ মানুষকে বোঝানো হচ্ছে বাংলাদেশের যেসব কালো টাকা সুইস ব্যাংকে জমা পড়ে আছে সেগুলো কিছুদিনের মধ্যেই উদ্ধার করে গরিব-অসহায় কর্মমুখী মানুষের মধ্যে বিনা সুদে বিতরণ করবে তারা।

এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে জনপ্রতি দেওয়া হবে এক লাখ টাকা। আর যারা মোটামুটি স্বাবলম্বী ও ব্যবসায়ী তাদেরকে দেওয়া হবে এক লাখ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা। শর্ত হিসেবে জুড়ে দিয়েছেন প্রতিমাসে এক হাজার করে টাকা কিস্তি দিলেই চলবে। আইডি কার্ড সংগ্রহের পাশাপাশি গোপনে কার্ড প্রতি ২০ টাকা থেকে শুরু হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে।

করিমগঞ্জ উপজেলার দরগাভিটা এলাকার গৃহবধূ মমতাজ বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা গরিব মানুষ বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে থাকি। যখন শুনেছি সুদ ছাড়া ঋণ দেওয়া হবে তাও আবার এক লাখ টাকা করে তাই এনআইডি কার্ডের ফটোকপি দিয়েছি। আমিসহ আমাদের বাড়ির পাঁচজনের এনআইডি কার্ডের ফটোকপি দিয়েছি। প্রতি ফটোকপি সঙ্গে ২০ টাকা করেও দিয়েছি।

পুলিশের সাবেক কনস্টেবল এ এম ফজলুল কাদের (বাবুল)

একই এলাকার গৃহবধূ সাফিয়া আক্তার বলেন, এক লাখ টাকার ঋণ দেওয়ার কথা বলে এনআইডি কার্ডের ফটোকপির সঙ্গে ১ হাজার করে টাকাও নিয়েছে আমাদের এলাকা থেকে। আমাদের বাড়ির তিনজন এক হাজার করে টাকা দিয়েছে।

করিমগঞ্জের জাঙ্গাল এলাকার বাবুল মিয়া বলেন, আমার বাড়িতে কয়েকদিন আগে পুলিশের সাবেক কনস্টেবল এ এম ফজলুল কাদের (বাবুল) এসে মিটিং করে গেছে। মিটিংয়ে তিনি বলে গেছেন, সুইস ব্যাংকে যে কালো টাকা পড়ে রয়েছে তা দেশে এনে আমাদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হবে। এক লাখ থেকে শুরু করে এক কোটি পর্যন্ত সুদ মুক্ত ঋণ দেওয়া হবে। প্রতিমাসে এক হাজার টাকা করে কিস্তিতে সেই টাকা পরিশোধ করা হবে। তাই আমরা মসজিদে মাইকিং করে এলাকার লোকদের কাছ থেকে ভোটার আইডি কার্ড নিয়েছি।

একই এলাকার কৃষক ফাইজউদ্দিন বলেন, এলাকায় আওয়াজ পড়ে গেছে বাবুল (পুলিশের সাবেক কনস্টেবল) সুইস ব্যাংক থেকে টাকা এনে মানুষের মধ্যে বিলি করে দেবে। আমরা গরিব মানুষ তাই এনআইডি কার্ডের ফটোকপি দিয়েছি। ফটোকপি দিয়ে যদি ঋণ নাও পাই তাইলে ক্ষতিতো আর কিছু হইলো না। তাই এনআইডি কার্ডের ফটোকপি দিয়েছি। এনআইডি কার্ডের ফটোকপি দিয়ে আমাদের কী আর ক্ষতি করবে।

এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক কনস্টেবল এ এম ফজলুল কাদের (বাবুল) ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের সংগঠনের নাম অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ। ঢাকা অফিস থেকে আমাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এলাকা থেকে এনআইডি কার্ড সংগ্রহ করে পাঠাতে। সুইস ব্যাংকের কালো টাকা দেশে এনে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেওয়া হবে। তাই আমরা এনআইডি কার্ড সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠাচ্ছি। আমি ইতোমধ্যেই করিমগঞ্জ উপজেলা থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষের এনআইডির ফটোকপি ঢাকা অফিসে পাঠিয়েছি। অফিস থেকে বলা হয়েছে প্রতিজনকে ১ লাখ থেকে শুরু করে ১ কোটি টাকাও দেয়া হতে পারে। এ ঋণ সুদ মুক্ত হবে। প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।

তাড়াইল উপজেলার ধলা ইউনিয়নের এক বাসিন্দা জানান, আমাদের এলাকার ফেরুনা নামের এক মেয়ে এই সংগঠনে ঢাকায় কাজ করে। ফেরুনা আর গুজাদিয়ার বাবুল পুলিশ মোবাইলে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে আইডি কার্ডের ফটোকপি সংগ্রহ করছে। যাদের কাছ থেকে আইডি কার্ডের কপি নেন, তাদের মধ্যে শিক্ষিত এবং স্মার্ট দেখে প্রতিনিধি নিয়োগ দেন। পরে সেই কর্মীর মাধ্যমে কার্ড সংগ্রহ করেন তারা। 

তিনি বলেন, বিশ্বাস অর্জনের জন্য আইডি কার্ডের ফটোকপি নেওয়ার সময় কারও সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করা হয় না। তাহলে টাকাটা নেয় কীভাবে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আইডি কার্ডের ফটোকপি জমা দেওয়ার পরে দ্রুত ঋণ পেতে যারা আগ্রহ প্রকাশ করে তাদের কাছ থেকেই কৌশলে হাতে হাতে বা বিকাশের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করে তারা।

কথিত অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ নামে সংগঠটির কিশোরগঞ্জের দায়িত্বে আছেন ফেরুনা আক্তার। তিনি থাকেন রাজধানীর রায়েরবাগ এলাকায়। তার বাড়ি জেলার তাড়াইল উপজেলার ধলা ইউনিয়নে। এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হয় মুঠোফোনে। 

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, তাদের সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ধানমন্ডি এলাকায় সিটি কলেজের পাশে। প্রতি শনিবার সেখানে বসেন তিনি। সংগঠনের চেয়ারম্যান তাকে কিশোরগঞ্জের দায়িত্ব দিয়েছেন। এরপর তিনি বিভিন্ন উপজেলায় গিয়ে মহিলাদের মাধ্যমে আইডি কার্ড সংগ্রহ করেছেন। এখন আর নিজে মাঠ পর্যায়ে যান না। তার মাধ্যমে দায়িত্বপ্রাপ্তরাই কাজ করছেন। এ পর্যন্ত জেলা থেকে সবমিলিয়ে লক্ষাধিক আইডি কার্ড কেন্দ্রীয় অফিসে জমা দিয়েছেন। তারা সবাই কিছুদিনের মধ্যেই বিনা সুদে ঋণ পাবেন।

তিনি বলেন, আপনাদের দোয়ায় কিশোরগঞ্জ থেকে লক্ষাধিক আইডি কার্ড সংগ্রহ করে দেওয়ায় অফিস প্রধান খুশি হয়ে সুনামগঞ্জের দায়িত্বটাও তাকেই দিয়েছেন। তবে টাকা নেওয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেছেন।

কিশোরগঞ্জ জেলা নির্বাচন অফিসার মোহাম্মদ আশ্রাফুল আলম বলেন, এনআইডি কার্ডের তথ্য ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্পদ। কার্ডের তথ্য প্রতারক চক্রের হাতে চলে গেলে ব্যক্তির ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই এনআইডি কার্ডের তথ্য কারও কাছে দেওয়া ঠিক নয়।

এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা সমবায় অফিসার উম্মে মরিয়ম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ নামে কিশোরগঞ্জে কোনো সমবায় সমিতির রেজিস্ট্রেশন নেই। তারা যদি সমবায় সমিতির নাম ভাঙিয়ে কাজ করে থাকে তাহলে বেআইনি।

এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইতোমধ্যে বিষয়টি পুলিশ সুপারকে জানানো হয়েছে। পুলিশ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। দ্রুতই চক্রটিকে আইনের আওয়াত নিয়ে আসা হবে।

এমএএস