কেটে গেছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাব। থেমে গেছে বৃষ্টি ও বাতাস। বাগেরহাটের বেশিরভাগ এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে নিজ বাড়িতে ফিরেছেন সাধারণ মানুষ। তবে ব্যতিক্রম সদর উপজেলার কাড়াপাড়া ইউনিয়নের মাঝিডাংগা এলাকা। ঘূর্ণিঝড়ের মৃদু আঘাতেই সোমবার (২৪ অক্টোবর) মধ্যরাতে ভেঙে যায় গ্রাম ও ভৈরব নদীর মধ্যবর্তী ১০ ফুট বাঁধ। এতেই প্লাবিত হয় পুরো গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত দুই শতাধিক পরিবার। রান্না বন্ধ হয়ে গেছে বেশিরভাগ পরিবারের। 

সরেজমিনে মঙ্গলবার দুপুরে দেখা যায়, মাঝিডাংগা-যাত্রাপুর সড়কের কাছে ভৈরব নদীর কোলঘেঁষে স্থানীয়দের দেওয়া রিং বাঁধ ভেঙে হু হু করে পানি ঢুকছে লোকালয়ে। ১০ থেকে ১২ জন লোক বাঁশ দিয়ে বালুর বস্তা ফেলে পানি আটকানোর কাজ করছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সোমবার মধ্যরাতে ঝড়ো বাতাস ও বৃষ্টি কমার কিছুক্ষণ পরেই ভেঙে যায় বাঁধটি। 

সেখানে কাজ করতে থাকা স্থানীয় সোহরাব হোসেন বলেন, রাতে ঝড়ের মধ্যে বাড়ি বসে আল্লাহকে ডাকছি। হঠাৎ করে দেখি ঘরের ভেতরে পানি। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দ্রুত পাশের স্কুলে গিয়ে উঠি।

শেখ কামরুজ্জামান রাসেল বলেন, পানিতে আমাদের বাড়িঘর সব যেমন তলিয়ে গেছে পাশাপাশি ভেসে গেছে ঘেরের মাছ। শুধু ঝড়ে না, প্রতিমাসে পূর্ণিমা-অমাবস্যায়র জোয়ারেও নদীর পানি আমাদের ঘরে প্রবেশ করে। গতকাল এক রাতেই এলাকার কৃষক-চাষিদের কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে।

বাঁধ নির্মাণের স্থান ছেড়ে গ্রামে প্রবেশ করতেই দেখা যায়, কোথাও রাস্তার চিহ্ন নেই। যতদূর দেখা যায় চারপাশ পানিতে প্লাবিত। হাঁটু সমান পানির মধ্যে দিয়ে চলাচল করছে লোকজন। বাচ্চারা বাড়ির উঠানে সাঁতার কাটছে, দুই একজন আবার জাল দিয়ে মাঠের মধ্যে মাছ ধরছেন। মাঠের সামনেই মাঝিডাংগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে বেশ কয়েকটি পরিবার অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে জয়নব বেগম নামে এক নারী বলেন, ছোট বাচ্চা থাকায় বাড়ির কী অবস্থা দেখতে যেতে পারিনি। হাঁটুর ওপরে পানি উঠে গেছে সব জায়গায়। কেউ কেউ বাড়িতে গেছে ভেসে যাওয়া জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে। সন্ধ্যার আগেই আবার চলে আসবে। কারণ বেশিরভাগ বাড়ির ঘরের মধ্যে পানি রয়েছে।

খুরশিদ বেগম নামের অপর এক নারী বলেন, স্বামী নেই, নিজে দিনমজুরের কাজ করে খাই। এমনি সময় আয় না থাকলে খাওয়া বন্ধ থাকে। আজকে উপজেলা প্রশাসন থেকে চাল-ডাল দেওয়া হলেও খাওয়া বন্ধ। রান্নার উপায় নেই। রান্নাঘর, শোবার ঘরে পানি উঠেছে। কোনো রকম শুকনো মুড়ি খেয়ে আছি।

স্থানীয় ঘের ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, আমার তিন বিঘার ঘের ছিল। এখন ঘেরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। পানিতে সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। মাছ বের হয়ে অন্তত দেড় লাখ টাকার ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা তার। 

তিনি আরও বলেন, আমাদের গ্রামে শতাধিক মানুষ ঘেরে মাছ চাষ করে জীবকা নির্বাহ করে। বছরের প্রায় শেষ সময়ে এ ধরনের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা আমাদের জন্য অসম্ভব।

হেলাল শেখ নামের এক কৃষক বলেন, টমেটো, ফুলকপি, ক্ষিরাসহ প্রায় ২০ হাজার টাকার বীজ ফেলেছি। ফলন আসার আগেই পানিতে সব শেষ হয়ে গেল। এই আয় দিয়েই আমার সংসার চলতো। একদিকে পানিবন্দি, অপরদিকে উপার্জজের উপায় নষ্ট হয়ে যাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন তিনি।

লুতফুন্নেছা নামে এক নারীর দাবি- ৩০ বছর ধরে এই ধরনের সমস্যায় রয়েছেন তারা। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বারবার বলেও কোনো লাভ হয়নি। প্রায় সময় ডুবতে হয়, তখন মানুষ আসে, ছবি তোলে, কাজের কাজ কিছু হয় না। 

হোসনেয়ারা বেগম বলেন, বাচ্চা ছোট। পানি হাঁটু সমান। এর মধ্যে পড়লে কীভাবে বাঁচবে। আমাদের জীবন নিয়ে তামাশা শুরু করেছে সবাই। আশ্বাস দেয়, কিন্তু বাঁধ হয় না।

স্থানীয়দের দাবি তিন থেকে চার কিলোমিটার এলাকা পানিতে থৈ থৈ করছে। নাম না প্রকাশের শর্তে স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, পানির কারণে রাতে আমাদের ঘুম হয়নি, আর ইউপি চেয়ারম্যানের ঘুম ভাঙেনি। বিকেল বেলায় এসে খোঁজখবর নিচ্ছেন। তবে উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বাঁধ নির্মাণ ও খাদ্য সহায়তা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুছাব্বেরুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক বাঁধ নির্মাণের জন্য স্থানীয়দের সহযোগিতায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পানিবন্দি মানুষদের জন্য শুকনো খাবার ও রাতের খাবারের ব্যবস্থা উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন যৌথ সমন্বয়ে করেছে। পাশাপাশি প্রায় এক কিলোমিটার টেকসই বেড়িবাঁধের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে আমাদের কথা হয়ে হয়েছে। আশা করি দ্রতই স্থানীয়দের দূর্ভোগ লাঘব হবে।

বাগেরহাট জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে জেলায় ২ হাজার ১৪০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে ৭৫০টি ঘের ও পুকুরের মাছ। এতে প্রায় ৮৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ৮৫০ হেক্টর রোপা আমনের জমি, ৩৭৫ হেক্টর শীতকালীন সবজি, ১৭ হেক্টর পানের বরজ, ১১০ হেক্টর কলা, ২০ হেক্টর মরিচ, ৭ হেক্টর পেঁপে ও ৬ হেক্টর বিভিন্ন শীতকালীন সবজির বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

মোংলা আবহওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী সোমবার একদিনে জেলায় ২১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর প্রভাবে প্লাবিত হয়েছে জেলার নিম্নাঞ্চল। মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) বিকেল পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল জেলার বেশিরভাগ এলাকা। তবে ঝড়ে কোনো মানুষ আহত বা নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।

অপরদিকে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সুন্দরবনের কোনো বন্যপ্রাণীর ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির।

তানজীম আহমেদ/আরএআর