চানাচুর মাটিতে ছিটাতে ছিটাতে সজোরে ডাকতে থাকেন, ‘তোতা-ময়নারা আয় আয় আয়, জান ময়নারা আয় আয় আয়। খেয়ে যা খাবার, সময় হয়েছে, আয় আয় আয়, ভয় নাই, আমি আছি, আয়। তখন ডাক শুনে আর দেরি না করে নিচে নামতে থাকে পাখির দল। পাখিরা যেন তার কাছে সন্তানের মতো।

বলছিলাম নাটোরের সিংড়া উপজেলার জোড়মল্লিকা গ্রামের দুলাল হোসেনর কথা। পেশায় তিনি একজন ঝালমুড়ি বিক্রেতা। বয়স প্রায় ৭০ বছর। দুলাল জোড়মল্লিকা গ্রামের মৃত কাচু প্রমাণিকের ছেলে। পরিবারে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ঝালমুড়ি বিক্রি করে প্রতিদিন যা আয় করেন তা দিয়ে চলে তার সংসার ও পাখিদের খাবার।

এলাকার মানুষের কাছে তিনি পাখিপ্রেমী হিসেবেই পরিচিত। প্রতিদিন সকাল-বিকেল দুবেলা দুলালের হাকডাকে ছুটে আসে শালিক, বুলবুলি, চড়ুই, ময়নাসহ নানা প্রজাতির শত শত পাখি। পাখিদের খাবার শেষ হলেই তিনি ফিরে যান কাজে। এভাবে ৫ বছর ধরে পাখিদের ভালোবেসে খাবার দিয়ে চলেছেন দুলাল। পাখিদের প্রতি দুলালের এমন ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ অনেকেই। পাখিদের সঙ্গে তার এমন মধুর সম্পর্ক এলাকায় বেশ আলোচনার সৃষ্টি করেছে। এলাকায় কেউ পাখি ধরতে বা শিকার করতে চাইলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।

জানা যায়, ৫ বছর ধরে পাখিদের খাবার দিয়ে চলেছেন তিনি। জোড়মল্লিকা সেতুর পাশে একটি ঝুপড়ি ঘরে ঝালমুড়ির পসরা সাজিয়ে বসেন দুলাল। বিকেল ৪টা নাগাদ বিদ্যুতের তারে এক এক করে এসে বসতে থাকে শালিক, বুলবুলি, চড়ুই, বাবুইসহ নানা পাখি। দুলাল তখন চানাচুর নিয়ে মাটিতে ছিটাতে ছিটাতে প্রতিদিনই সজোরে পাখিদের ডাকতে থাকেন।

স্থানীয়রা জানায়, ৫ বছর আগে ইউপি সদস্য পদে নির্বাচন করেন তিনি। তবে মানুষ তাকে আশা দিয়েও ভোট দেয়নি।  তখন পাখিদের নিয়মিত খাবার খাওয়ানো শুরু করেন।

পাখিপ্রেমী দুলাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানান, ছোটবেলা থেকেই পাখিদের প্রতি তার একটা টান ছিল। সেই টান থেকেই পাখিদের প্রতি এমন ভালোবাসা। প্রথম দিকে খাবার ছিটালে কিছু পাখি আসলেও পরবর্তীতে তার সঙ্গে পাখিদের সম্পর্ক মধুর হয়। তার ডাকে এখন শত শত পাখি হাজির হয়। দুলাল ও পাখিদের ভালোবাসার দৃশ্য দেখতে প্রতিদিন মানুষ তার দোকানে ভিড় জমায়। 

দোকানে শত ব্যস্ততা থাকলেও পাখিদের খাবারের কথা ভোলেন না তিনি। চানাচুর মাটিতে ছিটিয়ে ডাকতেই সাড়া দেয় ঝাঁক ঝাঁক নানা প্রজাতির পাখি। পাখিদের সঙ্গে তার আত্মার এক বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। তিনি পাখিদের সন্তানের মতোই আপন করে নিয়েছেন।

পাখিপ্রেমী দুলাল হোসেন আরও জানান, প্রতিদিন খাবার ছিটিয়ে তাদের জন্য বসে থাকি। দিনে দিনে পাখির সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিন পাখিদের জন্য ১২০ টাকার চানাচুর লাগে। নিজের পরিশ্রমের অর্থ দিয়ে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করি। কখনো কখনো নিজে না খেয়েও তাদের খাবার জোগাড় করি। তারা খেলে আমার প্রশান্তি লাগে, মনে তৃপ্তি লাগে।

স্থানীয় বাসিন্দা কালাম হোসেন জানান, পাখিপ্রেমী দুলালের সঙ্গে পাখিদের ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পাখিদের সঙ্গে মানুষের এমন সম্পর্ক হতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তিনি প্রতিদিন পাখিদের খাবার দেন। তার ডাকে পাখিরা ছুটে আসে।

আকবর আলী জানান, অনেক দিন থেকে দেখি তিনি পাখিদের নিয়মিত খাবার দেন। তার ডাকে একসঙ্গে প্রচুর পাখি জড়ো হয়। সত্যিই এ দৃশ্য ‍অসাধারণ। পাখিদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক দেখতে প্রতিদিন তার দোকানে মানুষ ছুটে আসে। 

স্কুলছাত্র জীবন সরকার জানায়, একজন মানুষ ডাকলেই পাখিরা চলে আসে, এই দৃশ্য দেখতে খুবই ভালো লাগে। তারা স্কুল থেকে বন্ধু-বান্ধব মিলে পাখি দেখতে আসে।

সিংড়া পরিবেশ ও প্রকৃতি আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবু জাফর সিদ্দিকী জানান, দুলাল হোসেন একজন বৃদ্ধ মানুষ হিসেবে পাখির প্রতি যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন তা অনন্য। পরিবেশ ও প্রকৃতি বাঁচাতে তিনি এগিয়ে এসেছেন। পাখিসহ সকল জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সবার এগিয়ে আসা দরকার। আমাদের উচিত জীবের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতা দেখানো।

চলনবিল পরিবেশ উন্নয়ন ও প্রকৃতি সংরক্ষণ ফোরামের সভাপতি রাজু আহমেদ জানান, পাখিদের খাওয়ানোর মাঝে আনন্দ পান ঝালমুড়ি বিক্রেতা দুলাল। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত থাকলেও তার পাখিপ্রেম বেশ ইতিবাচকভাবেই নিয়েছে পরিবারের সদস্যরা। পাখির সঙ্গে অভিনব ভালোবাসার খবর এখন এলাকার মানুষের মুখে মুখে।

নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হয়েও দুলাল পাখির প্রতি যে মমতা ও ভালোবাসা দেখিয়েছেন তা মহৎ কাজ। তিনি নিজ অর্থে প্রতিনিয়তই শত শত পাখির খাবারের ব্যবস্থা করছেন। পাখিদের প্রতি তার এমন ভালোবাসা অনন্য। তাকে দেখে সমাজের অনেক ব্যক্তি পাখিসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এগিয়ে আসবে বলে আশা করছি।

এসপি