২০১৭ সাল। সে সময় দেশ-বিদেশের সবার কাছে পরিচিত নাম ছিল সাতক্ষীরার মুক্তামনি। বিরল রোগে আক্রান্ত মুক্তামনিকে নিয়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করে। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চিকিৎসার দায়ভার গ্রহণ করেন। সেই বছরের ১১ জুলাই তাকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষার পর ধরা পড়ে তার হাতের রক্তনালী টিউমারে আক্রান্ত। তারপর কয়েক দফা চিকিৎসার পর তার হাতের অতিরিক্ত মাংসপিণ্ড অপসারণ করা হয়। ধীরে ধীরে ক্ষতস্থানে অগণিত পোকার জন্ম হয়। একইসঙ্গে মাংসপিণ্ড ভেঙে শিরায় রক্ত প্রবেশ করতে থাকে। ফলে মুক্তামনির অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যেতে থাকে। 

২০১৮ সালের ২৩ মে সকাল ৮টা ১০ মিনিটে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাঁশদাহ ইউনিয়নের দক্ষিণ কামারবায়সা গ্রামের নিজ বাড়িতে মুক্তামনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে দাদার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।

সে সময় মুক্তামনির মৃত্যুকে ঘিরে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মানুষ চোখের পানি ফেলেছিল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শোক বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এরপর কেটে গেছে কয়েকটা বছর। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে কেমন আছে মুক্তামনির পরিবার?
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতার একটি পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুক্তামনির বাবা ইব্রাহিম হোসেন। 

তিনি বলেন, মুক্তামনি মারা গেছে কয়েক বছর হয়ে গেল। এর মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মুক্তামনির যমজ বোন হিরামনিকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার কলিজার টুকরা মুক্তামনি বেঁচে থাকলে তারও বোনের মতো বিয়ে হতো। মুক্তামনির শূন্যতা সারা জীবন আমাদের মনে থেকে যাবে। মানুষকে বলতে হয় ভালো আছি, তবে সত্যি বলতে আমরা ভালো নেই। সব সময় একটা অপেক্ষা থাকে মুক্তামনির জন্য। মুক্তামনি অনেক ভালো মেয়ে ছিল। সে অনেক ধার্মিক ছিল। তার গোটা হাতে হাজার হাজার পোকার জন্ম হলেও সে বিন্দুমাত্র আল্লাহর প্রতি অখুশি হয়নি। বরং বলতো অনেক মানুষ তার চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থায় আছে। 

ইব্রাহিম হোসেন বলেন, সে সময় সাংবাদিকদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আসে মুক্তামনি। সকলের সহযোগিতায় ঢাকা মেডিকেলে তাকে ভর্তি করানো হয়। পরবর্তীতে সেখানে ছয় মাস উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী তার সকল দায়িত্বভার বহন করেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোক মুক্তার জন্য দোয়া করতেন। সব সময় ফোন করে খোঁজখবর নিতেন। এত কিছুর পরেও তাকে আটকে রাখা যায়নি।

মুক্তামনির মা আসমা খাতুন বলেন, সব সময় মুক্তার কথা মনে পড়ে। কিছুতেই ভুলতে পারি না। আমার সংসারের লক্ষ্মী ছিল মুক্তামনি। তাদের দুই বোনের মধ্যে খুব মিল ছিল। মুক্তার মৃত্যুর পর হিরামনি মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়ে। সব সময় মুক্তার স্মৃতি মনে পড়ে। বাড়িতে এখন ছোট ছেলে, স্বামী আর আমি থাকি। 

মুক্তার ছোট চাচা আহসান হাবিব বলেন, মুক্তার সঙ্গে বেশি সময় কেটেছে আমার। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তির পরে সেখানে দুই মাস আমি ছিলাম। অনেক গল্প করত মুক্তা। তবে কখনো তার মধ্যে অহংকার ছিল না। এত বড় রোগ তার শরীরে, তারপরও তার মধ্যে কখনো চিন্তার ছাপ দেখা যেত না। বরং সে সব সময় আনন্দ খুশিতে থাকত। মুক্তা বেঁচে থাকতে চাচাত বোনদের নাম রেখেছিল। সেই নামটি পরবর্তীতে বহাল রাখা হয়েছে। এখনো মনে হয় মুক্তা উঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সবার সঙ্গে চলছে, সবাইকে ডাকাডাকি করছে। তার স্মৃতি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে সকলের মাঝে।

সোহাগ হোসেন/এসপি