কুড়িগ্রাম জেলায় কর্মসংস্থানমূলক কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠলেও যোগাযোগব্যবস্থা, বিদ্যুৎ বিভাগ, কৃষি বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্বাস্থ্য বিভাগসহ সব বিভাগে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। এখানকার মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নদীভাঙন। তারা এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান চান।

এ জেলার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সরকারি নানা পদক্ষেপ চলমান রয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে দ্রুত মানুষের জীবনমান আরও উন্নত হবে মনে করছে কুড়িগ্রামের সচেতন মহল।

গত তিন বছরে জেলার যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের অধীনে ৫০ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। যার ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা। চলতি বছর আরও ২০ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মাণ করা হবে, যাতে বরাদ্দ হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা সংস্করণে ৩৫ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। গত তিন বছরে ৯টি সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ ৯টি সেতুর ব্যয় হয়েছে প্রায় ২২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। আরও ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে সাতটি সেতু নির্মাণকাজের প্রক্রিয়া চলছে।

কুড়িগ্রাম স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুদুর রহমান বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে জেলার যোগাযোগব্যবস্থা উন্নীতকরণের কাজ চলমান রয়েছে। দ্রুত এসব কাজ শেষ করা হবে।

জেলায় সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগে। কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট পল্লী বিদ্যুৎ কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, তিন বছর আগে এই সমিতির বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২৮ হাজার ৮২৭। গত বছর পর্যন্ত এ গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭।

কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার খাদেমুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে চরাঞ্চল ছাড়া সব উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন করা হয়েছে। কিছু চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ-সংযোগের কাজ চলমান রয়েছে। কুড়িগ্রামের জন্য আলাদা গ্রিড চালু হওয়ায় লোডশেডিং ও লো-ভোল্টেজ কমে গেছে।

কুড়িগ্রাম-নাগেশ্বরী মহাসড়ক

এ নিয়ে কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের মাইনুল ইসলাম ও মোস্তফা বলেন, কয়েক বছরের তুলনায় এলাকায় অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে পাকা রাস্তা ও বিদ্যুতের অনেক কাজ হয়েছে। আগে তো দিনে ১৫ থেকে ২০ বার করে বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করত, এখন এ সমস্যাটি আর নেই।

এত উন্নয়নের পাশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে নদীভাঙন। এর হাত থেকে রক্ষায় বড় ধরনের প্রকল্প গ্রহণের দাবি এ অঞ্চলের মানুষের। উন্নয়নের পাশাপাশি তারা এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান চান।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) অফিস সূত্রে জানা গেছে, বিগত বছরে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯২ কিলোমিটার মাটির বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ধরলা নদীর ৯টি স্থানে ১৭ কিলোমিটার সিসি ব্লকের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। নদীর আরও ৫টি স্থানে ১২ কিলোমিটার সিসি ব্লকের কাজ চলমান রয়েছে। এতে মোট ব্যয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী জেলায়, নদীভাঙন রোধ ও নদীতীর সংরক্ষণ কাজ রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলার তিনটি স্থানে চলমান রয়েছে। এ প্রকল্পটির ব্যয় ৪৭৯ কোটি টাকার। ৭ দশমিক তিন কিমি নদীতীর সংরক্ষণকাজ বাস্তবায়ন করা হবে।

পুলের পাড় রেল সেতুর চলমান কাজ

পাশাপাশি উলিপুর ও চিলমারী উপজেলায় ৪ দশমিক ৮ কিমি নদীতীর সংরক্ষণ ৫২ দশমিক ৭ কিমি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের মেরামতকাজ চলমান রয়েছে। যেখানে ব্যয় প্রায় ২০৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া ধরলা নদীতে একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে, সেখানে ১৬ দশমিক ৮ দশমিক ৪ কিমি নদীতীর সংরক্ষণকাজ হবে। পাশাপাশি নতুন বাঁধ ও বাঁধ মেরামত অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ প্রকল্পটির ব্যয় ৫৯৫ কোটি টাকা। এটির কাজ দ্রুত শুরু হবে। ঠিকাদার বাছাই করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, কুড়িগ্রাম জেলাটি নদীভাঙন ও বন্যাপ্রবণ এলাকা। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। এ কাজগুলো শেষ হলে কুড়িগ্রামের মানুষ বন্য ও নদীভাঙন থেকে রক্ষা পাবে। এতে এ জেলার মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে।

এ নিয়ে যাত্রাপুর ইউনিয়নের চরযাত্রাপুর গ্রামের মমিন ও আফজাল বলেন, আমাদের একজনের বাড়ি ছয়-সাতবার করে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে পড়েছে। আবাদি জমি তো নদীর মাঝে। বাড়ি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিতে নিতে আমাদের সব শেষ। সরকার কুড়িগ্রামে অনেক উন্নয়ন করেছে। যদি নদীভাঙনটা বন্ধ করতে পারত, আমরা অনেক উপকৃত হইতাম।

জানতে চাইলে যুব উন্নয়ন সংগঠন গ্রিন ভয়েস-এর কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সুজন মোহন্ত জানান, কুড়িগ্রামে গত তিন বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। যেমন বিদ্যুৎ, যোগাযোগব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা। শহর অঞ্চলে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলেও কুড়িগ্রাম একটি নদীমাতৃক জেলা। এখানে সাড়ে চার শতাধিক চরাঞ্চল রয়েছে। এসব চরের মানুষগুলোর জীবনমানের কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। তারা এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। এসব চরে যদি উন্নয়ন ঘটানো যায়, তাহলে জেলাজুড়ে সামগ্রিক উন্নয়ন চোখে পড়বে।

কুড়িগ্রাম-তিস্তা সড়ক

কুড়িগ্রাম সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক শ্যামল ভৌমিক বলেন, গত দুই-তিন বছরে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। এর মধ্যে রাস্তাঘাট, সেতু-কালভার্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিদ্যুৎ-সংযোগেরও উন্নয়ন দেখা গেছে। এসব উন্নয়ন শহর অঞ্চলে চোখে পড়লেও, এখানে বড় সমস্যা নদীভাঙন। প্রতিবছর শত শত বাড়ি ও আবাদি জমি নদীতে বিলীন হচ্ছে। তাই নদীভাঙন যদি স্থায়ীভাবে বন্ধ করা যায়, তাহলে অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়ন করা সম্ভব হবে।

কুড়িগ্রাম জেলা সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আব্রাহাম লিংকন বলেন, কুড়িগ্রামে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। ফুলবাড়ী-লালমনিরহাটের মাঝে শেখ হাসিনা ধরলা সেতু হয়ে যোগাযোগের একটি বড় মাধ্যম তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরে যেসব চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ যাওয়ার কথা নয়, সেই চরেও বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। এটি উন্নয়নের চমৎকার একটি ধারাবাহিকতা।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমান উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর কুড়িগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কুড়িগ্রামে ইতিমধ্যে বিভিন্ন উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে রংপুর-কুড়িগ্রাম চার লেন, কুড়িগ্রাম-সোনাহাট স্থলবন্দর চার লেন রাস্তার কাজ চলছে। কুড়িগ্রামের একমাত্র বড় সমস্যা হচ্ছে বন্যা। প্রতিবছর বন্যায় সেতু-কালভার্ট ও রাস্তার অনেক ক্ষতি হয়। এর স্থায়ী সমাধান করতে পারলে মানুষের জীবনমান আরও উন্নত হবে।

কুড়িগ্রাম-২ আসনের সংসদ সদস্য পনির উদ্দিন আহমেদ বলেন, কুড়িগ্রামে উন্নয়নের যে অগ্রযাত্রা, তা অব্যাহত রয়েছে। এখানে বড় সমস্যা হলো নদীভাঙন। যদি নদীভাঙনের স্থায়ী সমাধান করা হয়, তাহলে মানুষের জীবনমানের আরও উন্নয়ন ঘটবে।

এনএ