গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লিতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও তিন সাঁওতালকে হত্যার ছয় বছরেও শেষ হয়নি বিচার কাজ। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাটি পিবিআইয়ের তদন্তের পর সিআইডির তদন্ত শেষে চার্জশিট জমা হয়েছে আদালতে।

এ অবস্থায় ছয় বছরেও মামলাটির দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়া আর প্রধান অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষুব্ধ সাঁওতাল নেতাসহ হতাহতদের পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্তরা। তবে মামলার এ দীর্ঘসূত্রতার পেছনে মামলার বাদীর বার বার নারাজিকেই দায়ী করছে রাষ্ট্রপক্ষ।

অন্যদিকে বিরোধপূর্ণ ওই জমিতেই রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে সাঁওতালরা ঘুরে দাঁড়াতে গত বছর থেকে ইক্ষু খামারের সিংহভাগ জায়গা দখল করে বসতি স্থাপনসহ জমিতে ধান ও পুকুরে মাছ চাষ শুরু করেছেন। খামারের সিংহভাগ জায়গা দখলের বিষয়ে প্রশাসন ও মিল কর্তৃপক্ষ নীরব থাকলেও আতঙ্ক নিয়েই জমিতে বসবাস করছেন বলে জানান সাঁওতালরা।

২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর হামলার ঘটনা ঘটে। সেই থেকে দিনটি প্রতি বছর ‘সাঁওতাল হত্যা’ দিবস হিসেবে পালন করছে সাঁওতালরা। দিবসটি উপলক্ষে রোববার ছয় বছর পূর্তিতে সকাল থেকেই সেখানে শোকযাত্রা, পুষ্পস্তবক অর্পণ, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, স্মরণসভা ও সমাবেশসহ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জের রংপুর সুগার মিলস লিমিটেড আখ চাষের জন্য সাপমারা ও কাটাবাড়ী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের এক হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে। ৭৩ শতাংশ মুসলমান আর ২৭ শতাংশ সাঁওতালদের জমি অধিগ্রহণের পর ‘সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম’ নামে নামকরণ করা হয়। অধিগ্রহণকৃত জমি মিল কর্তৃপক্ষের কাছে কয়েক বছর আগে ইজারা নিয়ে ধান, পাট ও তামাকসহ বিভিন্ন আবাদ করে আসছিলেন সাঁওতালরা। এর মধ্যে ২০০২ সালে অধিগ্রহণ চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ এনে বাপ-দাদার জমি ফেরত চেয়ে আন্দোলন শুরু করেন সাঁওতালরা। আর ২০১৪ সালে তারা গঠন করে ‘সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি’। এরপর চলতে থাকে সাঁওতাল-বাঙালিদের ভূমি উদ্ধারের মানববন্ধন, মিছিল-মিটিংসহ বিভিন্ন কর্মসূচি।

এরপর ২০১৬ সালের ১ জুলাই সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের প্রায় ১০০ একর জমিতে ঝুপড়ি ঘর নির্মাণ করে বসবাস আর জমিতে চাষাবাদ শুরু করেন সাঁওতাল-বাঙালিরা। বাকি জমিতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ রোপণ করে।

পরে হঠাৎ কোনো নোটিশ ছাড়াই ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সকালে আখ কাটা নিয়ে পুলিশসহ চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ বাঁধে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু নামে তিনজন নিহত ও উভয়পক্ষের কমপক্ষে ৩০ জন আহত হন। ওই দিন সন্ধ্যার দিকে ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন। বাড়িঘরে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের আগুন দেওয়ার ভিডিও ফেসবুকে প্রকাশও হয় ওই সময়। 

হামলার ঘটনায় সাঁওতালদের পক্ষে থমাস হেমব্রম ওই বছরের ২৬ নভেম্বর গাইবান্ধা- ৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল আওয়াল, তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল হান্নান, খামারের ব্যবস্থাপক আব্দুল মজিদ, সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুল ও কাটাবারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রফিকসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে পুলিশসহ ৫০০-৬০০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় ২৫ আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। উদ্ধার করা হয় লুট করা একটি পাওয়ার ট্রিলার, দুটি শ্যালো মেশিন, একটি ভ্যান ও ৫৬টি ঢেউটিন। আসামিদের মধ্যে গোবিন্দগঞ্জের সারাই গ্রামের শাহজাহান আলীর ছেলে মিঠু মিয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন আদালতে।

দীর্ঘ তদন্ত শেষে পিবিআই ৯০ জনকে আসামি করে ২০১৯ সালের ২৮ জুন গোবিন্দগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিলেও প্রধান আসামি সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদসহ ‘প্রকৃত দোষীদের’ বাদ দেয়ার অভিযোগ এনে সেই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর আদালতে নারাজি পিটিশন দাখিল করেন মামলার বাদী থমাস হেমব্রম। পরে নারাজি পিটিশনের প্রেক্ষিতে একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। 

পরে তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ২ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৪৯৬ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। সেখানে মামলার মূল আসামিদের নাম আবারও বাদ দিয়ে চার্জশিট দেওয়ার অভিযোগ তুলে সেটিও প্রত‌্যাখান করে ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি আবারও সিআইডির প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি করে মামলার বাদী থমাস হেমব্রম। সেই নারাজি পিটিশনের প্রেক্ষিতে মামলাটি গত ৭ ডিসেম্বর শুনানি ও আলোচনা হয় আদালতে। এরপর তিন দফায় শুনানি পিছিয়ে ২০২৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নারাজি শুনানির দিন ধার্য করেছে আদালত।

অন্যদিকে হামলা, অগ্নিসংযোগ এবং হত্যার পর পুলিশ উল্টো তাদের ওপর হামলার অভিযোগে সাঁওতাল-বাঙালিদের বিরুদ্ধে মামলা করে। সেই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেছে পিবিআই। প্রতিবেদনে সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলীসহ ৪২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এ মামলায় গ্রেপ্তার চারজন বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। তিনজন মারা গেছেন।

অপরদিকে এমন ঘটনার মধ্য দিয়েই বিরোধপূর্ণ ওই সব জমিতে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সাঁওতালরা বিরোধিতা করলেও ইপিজেড স্থাপনের পক্ষে রয়েছে প্রশাসনসহ একটি অংশ। এই লক্ষে সরকারের পক্ষে গত বছরের ২৪ আগস্ট ইপিজেড বাস্তবায়নে রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল নজরুল ইসলাম। 

প্রশাসন বলছে, এই জমিতে ইপিজেড নির্মাণ সরকারের একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। ইপিজেড হলে এ অঞ্চলের শিক্ষিত ও বেকার যুবকরা চাকরির সুযোগ পাবেন। শুধু গাইবান্ধাই নয়, বৃহত্তর রংপুর বিভাগের কয়েকটি জেলা নানামুখী সুবিধা ভোগ করবে। বৃহত্তর রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের মাঝামাঝি এই গোবিন্দগঞ্জের ইপিজেড এ অঞ্চলের আমূল পরিবর্তন ঘটাবে। সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ আন্তর্জাতিক মানের কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করবে এই ইপিজেড।

অন্যদিকে সাঁওতালদের জমি ফেরতের এই আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশ রবিদাস ফোরাম এবং গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চ, সাঁকোয়া ব্রিজ ইপিজেড বাস্তবায়ন মঞ্চ, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ, আদিবাসী ইউনিয়ন ও জন উদ্যোগের মতো রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন। এসব সংগঠনের নেতারা সাঁওতাল পল্লিতে ইপিজেড স্থাপন বাতিলসহ পলাশবাড়ী উপজেলার সাঁকোয়া ব্রীজ এলাকায় স্থাপনের দাবি জানাচ্ছেন।

সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাসকে বলেন, এই বিচারহীনতা প্রমাণ করে সাঁওতালদের কতটা অবহেলার চোখে দেখা হয়। ভূমি উদ্ধার করতে গিয়ে জীবন দিয়েছে সাঁওতাল শ্যামল, মঙ্গল ও রমেশ। এখন সেই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। 

সাঁওতাল হত্যা মামলার বাদী থমাস হেমব্রম বলেন, সব গণমাধ্যমে প্রকাশিত আগুন লাগানোর ফুটেজ, ছবি প্রকাশ পেলেও এখন পর্যন্ত কোনো সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। মূল আসামিদের বাদ দিয়ে প্রথমবার পিবিআই চার্জশিট দেয়। পরে নারাজি করলে সিআইডিকে তদন্ত ভার দেন আদালত। কিন্তু সিআইডিও ঘটনার সঙ্গে জড়িত মূল  আসামিদের নাম বাদ দিয়ে পিবিআইয়ের পথেই হেঁটে চার্জশিট জমা দেয়। পরে আমি এই প্রতিবদেনও  প্রত্যাখ্যান করে নারাজি দিয়েছি। ছয় বছরেও মামলাটির দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। সুষ্ঠু বিচার না পেলে আরও জোরালো আন্দোলন করা হবে। 

তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আলোচিত এ মামলার বিচার দীর্ঘদিনেও শুরু না হওয়ার পেছনে বার বার নারাজি দেওয়ায় বাদীর উপরেই দোষ চাপাচ্ছেন। এ বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম‌্যাজিস্ট্রেট আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিউকিটর (এপিপি) অ‌্যাডভোকেট মো. মিজানুর রহমান মণ্ডল বলেন, পিবিআই ও সিআইডি মামলার চার্জশিট জমা দিয়েছে। কিন্তু বাদী পরপর দুই বার নারাজি দেওয়ায় বিচার কাজ শুরু হতে বিলম্ব হচ্ছে।

রিপন আকন্দ/আরএআর