ইতি আক্তারের (ছদ্মনাম) বয়স ২০ বছর। যৌনপল্লিতে জন্ম তার। জন্মের পর থেকেই শেফালী নামে এক যৌনকর্মীর কাছে ইতির বেড়ে ওঠা। তার বয়স যখন ১২ বছর তখন পালিত মা শেফালী মারা যান। পরবর্তীতে শেফালীর ঘরেই যৌনকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। এখনো জানেন না তার মা কে, কী নাম তার। বর্তমানে ইতির ঘরেও একটি সন্তান রয়েছে। টাঙ্গাইল যৌনপল্লির একটি আধাপাকা ঘরে ৩০০ টাকা দিন হিসেবে ভাড়া নিয়ে যৌনতা বিক্রি করেন ইতি।

শুধু ইতি আক্তার নয়, তার মতো ছয় শতাধিক নারী টাঙ্গাইল যৌনপল্লিতে যৌনতা বিক্রি করেন। তবে সাংবাদিক বা কোনো এনজিওর সঙ্গে কথা বলার সময় নেই তাদের। কারণ যে সময় তারা তাদের গল্প বলার জন্য ব্যয় করবে, সেই সময়ে একজন খদ্দের যোগাড় করতে পারবে। তাই বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলার সময় নেই তাদের। 

সরেজমিনে টাঙ্গাইল যৌনপল্লিতে গিয়ে দেখা গেছে, চারদিকে বাউন্ডারি দেওয়া যৌনপল্লির ভেতরে সারিবদ্ধভাবে অনেকগুলো আধাপাকা ঘর রয়েছে। এর মধ্যে একতলা বিশিষ্ট ঘরও আছে। তবে সেখানে একটি রুমের ভাড়া দিনে ১৫০০ টাকা। বাউন্ডারির কয়েকটি পয়েন্টে প্রবেশ পথ রয়েছে। ভেতরে যৌনপল্লি ছাড়াও মনোহারীর দোকান ও খাবার হোটেল রয়েছে। সেখানে দালালরা বসে থাকেন। এছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে যাওয়া খদ্দেররাও হোটেলগুলোর কাস্টমার। 

যৌনপল্লির বাউন্ডারির বাইরে নারীদের তেমন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা না গেলেও ভেতরে যার যার রুমের সামনে সেজেগুজে খদ্দেরদের আকৃষ্ট করতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ভেতরের গলিতেও তারা দাঁড়িয়ে খদ্দেরদের ইশারা করেন। খদ্দেররাও তাদের পছন্দ অনুযায়ী যৌনকর্মীর ঘরে যান। তবে সুন্দরী ও যৌনপল্লিতে নতুন আসা নারীরা রুমের বাইরে বের হন না তেমন। বিভিন্ন দালাল, সর্দারনী ও মোবাইলে যোগাযোগের মাধ্যমে খদ্দেররা তাদের রুমে যান। ভেতরে মাদক ব্যবসাও চলে দেদারছে। যৌনপল্লিতে থাকা অনেকেই বিভিন্ন মামলার আসামি।

যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (সেড) তথ্য অনুযায়ী, টাঙ্গাইলে ৩ দশমিক ১৪ একর জায়গা নিয়ে যৌনপল্লি অবস্থিত। ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী- সেখানে ৬১১ জন নারী যৌন পেশার সঙ্গে জড়িত। টাঙ্গাইল শহরের মাঝখানে কান্দাপাড়া এলাকায় ১৮১৮ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম যৌনপল্লি। ২০১৪ সালে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা এটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন। পরে যৌনকর্মী ও জমির মালিকরা উচ্চ আদালতে আবেদন করলে আদালত তাদের পক্ষে রায় দেন। পরে গুঁড়িয়ে দেওয়া বাড়িগুলো তারা ধীরে ধীরে পুনরায় নির্মাণ করেন। 

এদিকে টাঙ্গাইলের যৌনপল্লিতে নারী পাচার, বিক্রি ও নির্যাতনের সংখ্যা কমে গেলেও আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। যৌনকর্মীদের দেওয়া তথ্যে মতে, বছরে বিভিন্ন কারণে যৌনপল্লিতে ১০-১২ জন যৌনকর্মী আত্মহত্যা করেন। যাদের অধিকাংশের বয়স ২০-২৫ এর মধ্যে। আত্মহত্যাকারী সবাই ছিলেন মাদকাসক্ত। অন্যদিকে বয়স্ক যৌনকর্মীর সংখ্যা বাড়ছে টাঙ্গাইল যৌনপল্লিতে। এদের অধিকাংশই পল্লিতে বিভিন্ন ব্যবসা, মাদক বিক্রি ও দালালের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। 

যৌনকর্মী ইতি আক্তার বলেন, আমার মা এই পল্লিতেই কাজ করতেন। আমার জন্মের দিনই অন্য এক যৌনকর্মী লালন-পালনের জন্য আমাকে নেন। আমার মায়ের চেহারা কেমন, নাম কী, কিছুই জানি না। যিনি আমাকে পালন করেছেন তিনিও এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে পালিত মায়ের চিকিৎসা, ঘর ভাড়া ও খাবার টাকা জোগাড়ের জন্য বাধ্য হয়েই এই পেশায় জড়িয়ে পড়ি। তার আগে এক ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়েছিল। কিন্তু সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। ফলে সব কিছু বিসর্জন দিয়ে এই পেশায় নেমেছি। প্রথম দিকে ভালো টাকা উপার্জন করতাম। কিন্তু এখন সন্তান হওয়ায় তেমন খদ্দের পাই না। আমারও হয়তো মায়ের মতো এখানেই মৃত্যু হবে। তবে আমার সন্তানকে এই অন্ধকার জগত থেকে বের করব। সে যেন না জানে তার মা একজন যৌনকর্মী ছিল। 

২৩ বছর বয়সী সুমি খাতুন (ছদ্মনাম) বলেন, তিন ভাইয়ের একমাত্র বোন আমি। সংসারে অভাব অনটন থাকায় ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় এক অটোরিকশা চালকের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। স্বামী অন্যত্র আরেকটা বিয়ে করেন। এরপর বাবার বাড়িতে ঠাঁই হয় আমার। একজনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। একপযার্য়ে আমার সব কিছু লুটে নিয়ে সে পালিয়ে যায়। পরে এলাকার একজন আমাকে ঢাকায় চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দেন। তার সঙ্গে ঢাকায় যাওয়ার পথে দৌলতদিয়া এলাকায় হোটেলে খাওয়ার পর সেখানে রেখে পালিয়ে যায়। এরপর দৌলতদিয়া ঘাট যৌনপল্লির রুপা নামে এক বাড়িওয়ালার জিম্মায় যৌনপেশায় যুক্ত হতে বাধ্য করা হয়। 

তিনি বলেন, প্রথম কয়েকমাস সারারাত জেগে ৫-৭ জনের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে। এতে শরীর শুকিয়ে যায়। পরে যৌনপল্লী থেকেই মোটা হওয়ার ওষুধ দেয়। এরপর সেখান থেকে টাঙ্গাইল যৌনপল্লিতে চলে আসি। এখানে ভালোই আছি। নিজস্ব রুম, স্বাধীনতা, সবই আছে। তবে বাড়ির লোকজন জানে না আমি এই পেশায় আছি। সবাই জানে গার্মেন্টসে কাজ করে বাড়িতে টাকা পাঠাই। 

সুমি বলেন, যে দালাল আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে তাকে যদি বেঁচে থাকতে সামনে পেতাম, তাহলে একটা থাপ্পড় দিতাম। জিজ্ঞাসা করতাম কেন আমাকে অন্ধকার জগতে বিক্রি করে দিয়েছে। 

৪০ বছরের বেদেনা। তিনি এখন আর কাজ করেন না। তিনি যৌনপল্লিতে একটি বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি কাপড়ের ব্যবসা করেন। 

বেদেনা জানান, পাঁচ বছর বয়সে বোনের সঙ্গে টাঙ্গাইল যৌনপল্লিতে আসেন তিনি। এর আগে তার বোনকে প্রতারণার মাধ্যমে এক ব্যক্তি যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেন। বেদেনা যৌনপল্লিতে বড় হতে থাকেন। পরে তার বোন দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে মারা গেলে দায়িত্ব নেন বেদেনা। পরে পল্লিতে বোনের ঘরেই কাজ শুরু করেন তিনি। যৌনতা বিক্রির টাকায় বোনের সন্তানদের লালন-পালন করেন। পরে তিনিও বিয়ে করেন। তার ঘরেও ছেলে সন্তান রয়েছে। ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু পরিবার জানে না বেদেনা অন্ধকার জগতের মানুষ। 

কয়েকজন যৌনকর্মী জানান, দালালরা অন্যায়ভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করেন। তাদের সঙ্গে সর্দারনীরা জড়িত। কেউ বেশি উপার্জন করলেও মাদক অথবা নারী পাচারকারী বলে পুলিশে খবর দেয়। পুলিশও দালালদের কথায় পল্লিতে এসে যৌনকর্মীদের আটক করে। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে বিপুল টাকার ক্ষতি হয়। বিভিন্ন খাতে টাকার ভাগ দিতে হয়। অনেক নিরীহ মেয়ে এখানে এসে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে। কোনো স্বাস্থ্যকর্মীও আসে না পল্লিতে। অনেকেই ঋণগ্রস্ত। এনজিও কর্মীরা ঋণের কিস্তির জন্য অনেক কথা শোনায়। 

জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. শাহআলম বলেন, যৌনপল্লির বাসিন্দাদের কোনো তালিকা কিংবা তাদের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। সেখানে যদি কেউ বয়স্কভাতার উপযোগী হয়, তাহলে সঠিক আইডি কার্ডের মাধ্যমে তাদের ভাতার আওতায় আনা হয়। 

টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) শরফুদ্দিন বলেন, টাঙ্গাইলের যৌনপল্লিতে বিট পুলিশিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। সেখানে নারী পাচার, নির্যাতন ও মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বিগত সময়ের মতো আর নেই। আগের মতো এখন আর যৌনপল্লি থেকে অভিযোগ আসে না। এরপরও যৌনপল্লিতে কোনো কিছু ঘটলেই পুলিশ নিয়মিত মামলা গ্রহণ করে। মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

আরএআর