‘আমার ভাইরে বুকে আইন্না দাও। আমার ময়না না খাইয়া মরছে গো। আমার ভাইরে আধাটা রুটি দিছে। আধা রুটি খাইয়া ছটফটিয়ে মরছে গো। ২১ দিন আধা রুটি খাইয়া মরছে গো।’ এভাবেই ছবি বুকে নিয়ে বিলাপ করছিলেন সৌদি আরবে মারা যাওয়া আকবরের বড় বোন লাকিয়া খাতুন। 

প্রবাসী আকবর সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভপুর উপজেলার বাঁধাঘাট দক্ষিণ ইউপির সিরাজপুর গ্রামের আব্দুল মোতালিবের ছোট ছেলে। কাজের অভাবে দুর্গম মরুভূমিতে দীর্ঘদিন অনাহারে, অর্ধাহারে ও বিনা চিকিৎসায় গত শনিবার (৫ নভেম্বর) তার মৃত্যু হয়।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, পরিবারের সচ্ছলতার আশায় পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট আকবর সৌদি আরবে যান।  কিস্তি ও জমি বিক্রির টাকায় গত মার্চ মাসে বিদেশে পাড়ি জমান তিনি। একই গ্রামের জালাল উদ্দিনের ছেলে সৌদি প্রবাসী শহিদ মিয়ার মাধ্যমে আকবরসহ তিন যুবক একসাথে বিদেশে যান। 

কোম্পানির তিন মাসের ভিসায় ৪ লাখ টাকার চুক্তিতে সৌদি আরবে যান তারা। পরে সৌদি প্রবাসী দালাল শহিদ তাদের আকামা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে সবাইকে মরুভূমিতে নিয়ে যান। কাজ পেতে টাকা লাগবে বলে দেশে তাদের পরিবারের কাছ থেকে আরও টাকা নেন শহিদের বাবা জালাল। ওইদিকে কাজের অভাবে দুর্গম মরুভূমিতে দীর্ঘদিন অনাহারে, অর্ধাহারে ও বিনা চিকিৎসায় গত শনিবার চারজনের মধ্যে আকবরের মৃত্যু হয়।

আকবরের মৃত্যুর খবর পেয়ে শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে তার পুরো পরিবার। ছেলের এমন অমানবিক মৃত্যুর কথা শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মা। কাঁদতে কাঁদতে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন তার বোন। টাকার লোভে আকবরকে হত্যা করা হয়েছে বলে থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন তার বড় ভাই আব্দুস সালাম। 

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, কোম্পানির কাজ দেবে বলে ৪ লাখ টাকা দিয়ে আমার ভাইকে বিদেশ নিয়েছে। কোম্পানিতে না নিয়ে কয়েকদিন তার বাসায় রাখছে। তারপর আমার ভাইকে নিয়ে গেছে মরুভূমিতে। সেখানে তাদের কোনো খাবার, কাপড়, চিকিৎসা কিছুই দেয় নাই। মরুভূমিতে আমার ভাই না খেয়ে মারা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি আমার ভাইয়ের লাশটা দেশে নিয়ে আসতে চাই। 

আকবর

বাবা আব্দুল মোতালিব বলেন, ‘জালাল উদ্দিন ও তার বউ আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমার ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছে। আকামা দেবে বলে দেয় নাই। খুব কষ্টে জীবন পার করছে আমার পুতে। মরুভূমি পাঠাইয়া কোনো খুঁজ খবর নেয়নি। খাবার নাই, বিছনা নাই, পানি নাই। একটা রুটি ৪ জনে ভাগ করে খেয়েছে। কপি এনে লবন দিয়ে সিদ্ধ করে খাইছে। কলিজা ফেটে গেছে আমার। এখন আমার ছেলের লাশটা চাই, নিজ হাতে ছেলেকে মাটি দিতে চাই।’ 

সৌদি আরবে অবস্থানরত রাসেল, নুর আলমসহ বাকি তিনজনেরও একই অবস্থা। বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় রসদ পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন তারা। দুঃখ-কষ্টে মানবেতর জীবন পার করছে জানিয়ে দেশে ফেরার আকুতি জানিয়ে পরিবারের কাছে ভিডিও পাঠিয়েছেন ওই তিন যুবক। আকবরের মৃত্যুর পর তারা আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তাদের বাবা-মায়ের এখন একটাই দাবি দ্রুত জীবিত অবস্থায় দেশে ফিরিয়ে দেওয়া হোক তাদের সন্তানদের। 

নুর আলমের বাবা মিরাজ মিয়া বলেন, জালাল আর শহিদকে প্রথমে দিয়েছি ৪ লাখ টাকা। আকামা লাগাবে বলে পরে আরও ২০ হাজার দাবি করলে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছি। এরপর মক্কা থেকে আমার ছেলেকে মরুভূমি নিয়ে গেছে। সেখানে তারা ৪ জনের মধ্যে একজন মারা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি বিচারপ্রার্থী। 

নুরের মা বলেন, অনেক আশা ভরসা করে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিলাম। ৭ মাস হয় কোনো কাজ পায়নি। আকবরের মৃত্যুতে ভয়ে আমার ছেলে হার্টফেইল করছে। তারে দেখার মতো কেউ নেই সেখানে। এখন আমার আর ছেলেরে দেশে ফেরত চাই। 

অভিযুক্ত জালাল উদ্দিনকে তার বাসায় গিয়ে না পাওয়া গেলেও তার স্ত্রী ও শহিদের মা রাজিয়া খাতুন অতিরিক্ত টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, সৌদিতে তাদের কাজ পাইয়ে দিতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে এই টাকা লেগেছে। তবে আকবরের মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে দাবি করেন তারা। তিনি আরও বলেন, তাদেরকে এসি রুমে রেখে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার ছেলে শহিদ রক্ত বিক্রি করে হলেও আকবরের মৃতদেহ দেশে পৌঁছাবে।

সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. এহসান শাহ বলেন, আমি অভিযোগের বিষয়ে শুনেছি। ওই এলাকার ৪-৫ জনকে নিয়ে গেছে। চাকরি দেয়ার কথা বলে নিলেও চাকরি দিতে পারেনি। অনাহারে কষ্টে মানবেতর জীবন পার করছে। এ বিষয়ে একটি অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে বিশ্বম্ভপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছি।

সোহানুর রহমান সোহান/আরকে