নাসিকে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের ফ্ল্যাট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের আবাসন প্রকল্পের ফ্ল্যাট হস্তান্তরের কার্যক্রমে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি সম্পন্ন হওয়া পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলে অনৈতিকভাবে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।
তাদের অভিযোগ, দাবি করা অর্থ দিতে না পারায় ৩১টি পরিবার তাদের ফ্ল্যাট বুঝে পায়নি। এছাড়া ফ্ল্যাট পেতে মুসলিম নারীকে ধর্মান্তরের প্রস্তাব দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। তবে নাসিকের দাবি, কোথাও কোনো অনিয়ম হয়নি। প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন নগর প্রশাসনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
বিজ্ঞাপন
নগর ভবনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন শহরের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের আবাসন নিশ্চিত করতে সাতটি বহুতল ভবনে ৫৪৯টি ফ্ল্যাট নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে নগরীর ইসদাইর ও ঋষিপাড়া এলাকায় সদ্য নির্মিত দুটি ভবনে হরিজন কলোনির বাসিন্দাদের স্থানান্তরের কার্যক্রম চলমান আছে। ওই দুটি ভবনের মধ্যে ইসদাইরে ১০৮টি ফ্ল্যাটে টানবাজার হরিজন কলোনির ৭০টির মতো পরিবার ও ঋষিপাড়ার ২৬১টি ফ্ল্যাটের মধ্যে প্রায় ৪৫টি পরিবারকে স্থানান্তর করা হয়েছে। হরিজন কলোনিতে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের জন্য আরকেটি নতুন ভবন নির্মাণের জন্য বসবাসকারীদের অস্থায়ীভাবে স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে নগর প্রশাসন।
এদিকে টানকাজার হরিজন কলোনি ঘুরে জানা গেছে, নাসিকের ১৫ নং ওয়ার্ডের ঋষিপাড়ায় সদ্য নির্মিত ভবনে বাসিন্দাদের স্থানান্তর করার কাজে নাসিককে সহায়তা করার নামে জনপ্রতি ২০-৫০ হাজার টাকা দাবি করছে হরিজন সমাজ সেবা সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মামুন চন্দ্র দাস ও হরিজন পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি বুচ্চু লাল। টাকার বিনিময়ে সুবিধাজনক ফ্ল্যাটে ৪৫টি পরিবারকে স্থানান্তর করা হয়েছে। দাবি করা টাকা দিতে না পাড়ায় আরও ৩১টি পরিবারকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিচ্ছেন না তারা।
বিজ্ঞাপন
অভিযোগ রয়েছে, উন্নয়ন ফি ও সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও নিরাপত্তার নাম করে প্রতিটি পরিবার থেকে নগদ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে মামুন চন্দ্র দাস ও বুচ্চু লাল। তাছাড়া ফ্ল্যাট পেতে এক মুসলিম নারীকে ধর্মান্তারিত হয়ে সনাতন ধর্ম গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছেন মামুন চন্দ্র। ধর্মান্তরিত না হওয়ায় ফ্ল্যাট বুঝে পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ ওই নারীর।
অভিযুক্ত মামুন হরিজন কলোনিতে মাদক ব্যবসার নেতৃত্বে আছেন বলেও অভিযোগ আছে। এর আগে তাকে মাদকসহ র্যাব আটক করেছিল। বর্তমানে তিনি র্যাবের মামলায় জামিনে আছেন।
এসব বিষয় জানতে চাইলে মামুন চন্দ্র দাস ও তার লোকজন গণমাধ্যমকর্মীদের কাজে বাধা দিয়ে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এক পর্যায়ে তারা একত্রিত হয়ে তেড়ে আসেন। এ সময় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো এগিয়ে এলে তারা তর্কে জড়ায়। তবে এতসব অনিয়মের বিষয়ে মেয়র বরাবর সমাধান চেয়েও কোনো প্রতিকার পায়নি বলে দাবি ভুক্তভোগীদের।
হরিজন কলোনির ভুক্তভোগী এক নারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাকে ফ্ল্যাট দিয়েছে। কিন্তু ফ্ল্যাটে উঠতে হলে আমাকে মন্দিরে গিয়ে শাখা-সিঁদুর পরে বিয়ে করে যেতে হবে। মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করলে আমাকে পুরো ফ্ল্যাট দিয়ে দিবে বলে প্রস্তাব করেছে। আমি এখানে গত ৩০ বছর ধরে বসবাস করছি। এখানে সবার সঙ্গেই আমার সুসম্পর্ক আছে। ৮ বছর আগে আমার এখানকার প্রহলাদ দাসের সঙ্গে বিয়ে হয়। তিনি একজন খাজা বাবাভক্ত। আমাদের দুই সন্তান রয়েছে। তারা দুজনই মুসলিম ধর্ম পালন করে। আমি একজন মুসলিম হয়ে ধর্ম পরিবর্তন করে ফ্ল্যাটে যাব?
তিনি আরও অভিযোগ করে বলেন, আমাকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলে টাকা দাবি করে। তাদের কাছে গেলে আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু এভাবেই ঘুরাচ্ছেন। মামুন চন্দ্র দাস কখনো ২০ আবার কখনো ৩০ হাজার টাকা দাবি করে। উন্নয়নের নামে প্রতি পরিবার থেকে ৫-১০ হাজার করে টাকা নিচ্ছে, কী উন্নয়ন হবে তা আমরা জানি না। দুই পরিবারের জন্য একটি করে ফ্ল্যাট বরাদ্দ থাকলেও তিনি অতিরিক্ত টাকা দিলে এককভাবে ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা বলছেন।
হরিজন পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি বুচ্চু লাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেয়র মহোদয় আমাদের দায়িত্ব দিয়েছে দুটি পরিবারকে একটি করে ফ্ল্যাট দেওয়ার জন্য। ফ্ল্যাটের চাবি দেয় সিটি কর্পোরেশন, আমরা শুধু সঙ্গে করে নিয়ে যাই। এখন আপনি যদি না যান, তাহলে ফ্ল্যাট কিভাবে পাবেন? আমরা হ্যান্ড-মাইকে ঘোষণা দিয়ে সবাইকে বলেছি। এ সময় টাকা দাবির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কারো কাছেই টাকা দাবি করিনি। প্রমাণ দেখাতে পারবেন? বলে উত্তেজিত হয়ে পড়েন তিনি।
হরিজন সমাজ সেবা সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মামুন চন্দ্র দাস একই সুরে সুর মিলিয়ে বলেন, আমি কারো কাছ থেকে টাকা চাইনি। আপনাকে কে বলছে? আপনার বিরুদ্ধে ১০ জনের বেশি বাসিন্দা সুস্পষ্ট অভিযোগ করেছে বলে জানালে তিনি বলেন, এগুলো মিথ্যা, বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রমূলক। মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন, এমন অভিযোগ রয়েছে স্থানীয়দের। এই বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী? উত্তরে তিনি বলেন, অমি মাদক নির্মূলে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। আমি মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত না। তবে এর আগে মাদকসহ র্যাবের কাছে গ্রেপ্তারের বিষয়ে তিনি বলেন, র্যাব আমাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। আমার ১৬ লিটারের অনুমতি আছে, র্যাব অভিযান করে ২১ লিটার মদ পেয়েছিল। সেদিন থার্টি ফাস্ট নাইট ছিল, মদ আমার কাছে কিংবা হাতে পাইনি, এটা ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের আবাসন নিশ্চিত করতে কাজ করছে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন। ইতোমধ্যে সাতটি ভবন নির্মাণের প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে কোনোটির নির্মাণকাজ শেষ, কোনোটি শেষের পথে। এরই মধ্যে আমাদের ইসদাইর ও ঋষিপাড়া এলাকায় মোট ৩৬৯টি ফ্ল্যাট হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলমান আছে। প্রায় শতাধিক পরিবারকে স্থানান্তর করা হয়েছে।
হস্তান্তরের সময় হরিজন কলোনির মামুন চন্দ্র দাস ও বুচ্চা লাল নামে দুই ব্যক্তি নাসিকের নাম ভাঙিয়ে অর্থ আত্মসাত করছে বলে স্থানীয়রা মেয়র বরাবর অভিযোগ করেছেন। এই বিষয়ে নগর প্রশাসন কী পদক্ষেপ নিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেয়র বরাবর অভিযোগ হয়েছে। তবে সত্য অভিযোগের অনুলিপি এখনো হাতে আসেনি।
পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের ফ্ল্যাটে স্থানান্তরের জন্য নাসিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। এর বাইরে আমরা কাউকেই দায়িত্ব দেইনি। তবে কেউ যদি নাসিকের নাম ভাঙিয়ে অনৈতিকভাবে অর্থ আত্মসাত করে থাকে, প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিন রুমের একটি ফ্ল্যাটে দুই পরিবারকে বরাদ্ধ দেওয়া মানবিক কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের আবাসন বসবাসের যোগ্য পরিবেশেই নিশ্চিত করা হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে আমাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। তাদের আবাসন প্রক্রিয়া যেন মানবিক হয়, সেই লক্ষ্যে কাজ করবে নগর প্রশাসন।
এসপি