আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের আশায় দিন কাটছে তাদের

‘বাবারে মোর কেউ নাই। একনা ব্যাটা আছিলো তাও মারা গেইছে। বেটি দুইটার বিয়্যাও হইছে। ওমরা জামাইসহ আলাদা থাকে। হামরা গরিব মানুষ নিজের জাগাজমি নাই। মাইনসের জমিত কোনমতে ঝুপড়ি ঘর থুলি আছি। আগের মতো মুই এলা কামলা দিবার পারো না, শরীরের অবস্থাও খুব খারাপ। মাইনষের বাড়ি বাড়ি ঘুরি যা জোটে তা দিয়্যা সংসার চলে। ইউএনও স্যারোক দরখাস্ত দিচু, চেয়ারম্যান-মেম্বারোকও কচু। কিন্তু আইজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণের ঘর পাই না। প্রধানমন্ত্রীর লোকেরা হামাক গরিব মনে করে না।’

এভাবেই কথাগুলো বলেছিলেন রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার মনসুর আলী। তিনি উপজেলার লোহানীপাড়া ইউনিয়নের সাহেবগঞ্জ সাহাপাড়া গ্রামের মৃত আলীমুদ্দির ছেলে। ভূমিহীন মনসুর আলীর বয়স সত্তর পেরিয়েছে। পরিবারে উপার্জনক্ষম কেউ না থাকায় স্ত্রীকে নিয়ে কখনো অর্ধাহারে বা অনাহারে দিন কাটে তার। এখন প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের আশায় দিন কাটছে তার। এজন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ অনেকেই অনুরোধ করেছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত আবেদনও করেছেন। কিন্তু আজও মেলেনি সরকারি ঘর।

বৃদ্ধ মনসুর আলী বলেন, ‘হামরা তো টাকা দিবার পাবার নাই, ওই তকনে হামার ঘর নাই। মোর মত মাইনষে যদি সরকারি ঘর না পায় তাইলে কে পাইবে? মুইতো সবাকে ধরচু কেউ তো কোনো ব্যবস্থা করি দিলেনা। মোর সামর্থ্য থাকলে মুই প্রয়োজনে ঘরের জনতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেনু হয়। এ্যটে প্রধানমন্ত্রী যাগোর দায়িত্ব দিচে তামরা তো হামার মতো গরিবোক গরিবে মনে কর না।’

সাহেবগঞ্জ সাহাপাড়া এলাকায় স্থানীয় শাহ লিটু আনামের জমিতে ছোট্ট কুঁড়ে ঘর তুলে থাকেন বৃদ্ধ মনসুর আলী। পাটখড়ির বেড়া দিয়ে ঘেরা ওই ঘরে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করে আসছেন তিনি ও তার স্ত্রী। দীর্ঘ দিন ধরে স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে (ইউপি সদস্য) বহুবার বলার পরও কোনো ব্যবস্থা না হওয়াতে এ বছরের এপ্রিল মাসে আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর বরাদ্দ পাওয়ার আশায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত আবেদনও করেছেন তিনি।

মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর না পাওয়ার আক্ষেপ শুধু মনসুর আলীর একার নয়। উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া এলাকার রুহুল আমিন ও লোহানীপাড়া ইউনিয়নের কচুয়া মণ্ডলপাড়া গ্রামের বিধবা মাহমুদা বেগমেরও একই অভিযোগ।

একই উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের ভূমিহীন রুহুল আমিন বলেন, ‘মোর জীবনোত অনেক কষ্ট। বউ ছাড়ি চলি গেইছে। একটা ব্যাটা সেটাও মোক দ্যাকে না, বউ-ছাওয়াক নিয়্যা আলাদা থাকে। মুই এলাকার কেতা মিয়ার বাড়ির উঠানোত একটা ঘর করি আচু। কামকাজ করার মতো শক্তি নাই। মানইসে খাবার দিলে খাওয়া হয়, না হইলে উপ্যাস থাকা নাগে। মোর টাকা-পাইসাও নাই। চেয়ারম্যান-মেম্বারোক কচু মোক একটা সরকারি ঘর লাগবে। মরার আগোত ওই ঘরোত একটা সুখোক থাকার ইচ্ছা।’

লোহানীপাড়া ইউনিয়নের কচুয়া মণ্ডলপাড়া গ্রামের বিধবা মাহমুদা বেগমের আক্ষেপের শেষ নেই। ১৪ বছর আগে তার স্বামী মারা গেছেন। সংসারে একমাত্র ছেলে রয়েছে কিন্তু তিনিও বিয়ের পর মাকে ছেড়ে অন্যত্র থাকেন। বিধবা মাহমুদা গ্রামের ভুট্টু মিয়ার বাড়ির সামনে দুলাল ডাক্তারের জমির উপর ঘর করে বসবাস করছেন। বয়স পঞ্চাশ পার হলেও এখনো কোনো সরকারি ভাতা সুবিধা পাননি তিনি। মানবেতর জীবন কাটানো মাহমুদা বেগমও চান প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ঘরে থাকতে।

তবে স্থানীয়রা জানান, আবাসন গুচ্ছগ্রাম আশ্রয়ণ প্রকল্পে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মধ্যে ঘর বিতরণে অনিয়ম হয়েছে। রয়েছে আর্থিক লেনদেন ও দলীয়করণের অভিযোগ। শুধু তাই নয়, পাকা বাড়িঘর থাকা অনেক স্বচ্ছল ব্যক্তিও উপহারের ঘর পেয়েছন। অথচ রুহুল আমিন, মনসুর আলীর মত প্রকৃত ভূমিহীনরা সরকারি আশ্রয়ণের সুবিধা থেকে রয়েছেন বঞ্চিত।

কুতুবপুর নাগেরহাট বন্দরের আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা গ্রাম পুলিশ সদস্য মানিক রাম ও গুলজার হোসেন জানান, সুষ্ঠু তদন্ত ও যাচাই-বাছাই করলেই বেরিয়ে পড়বে অনিয়মের থলের বিড়াল।

নয়াপাড়া গ্রামের মুজিবর রহমান জানান, কুতুবপুর বাগানপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে যারা ঘর পেয়েছেন তাদের মধ্যে ভূমিহীন এর সংখ্যা খুবই নগণ্য। এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রথম ধাপের ভূমিহীনদের জন্য ঘর তৈরি করা হয় ৩০টি। দ্বিতীয় ধাপে ৮টি অথচ এসব ঘরে প্রকৃত ভূমিহীনদের মাথা গোজার ঠাঁই হয়নি।

এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুতুবপুর ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান বলেন, আমরা তো নিজেরা এসব ঘর বরাদ্দের তালিকা তৈরি করিনি। ভূমিহীনদের তালিকা চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ করা হয়েছে। তালিকায় প্রকৃত ভূমিহীনদের নাম তালিকা অন্তর্ভুক্ত করা ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, দুই-একজন হয়তো বাদ পড়তে পারে। তবে পরবর্তীতে তারাও ঘর পাবেন।

কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাক চৌধুরী বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো বিগত চেয়ারম্যানের সময়ে বরাদ্দ হয়েছে। ভূমিহীনদের তালিকা তৈরির বিষয়টিও আমার জানা নেই। তবে প্রকৃত ভূমিহীনদের কেউ যদি বাদ পড়ে থাকলে আমি বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে অবগত করব। এটি যেহেতু চলমান প্রকল্প আশা করা যায় পর্যায়ক্রমে অন্যরাও ঘর পাবে।

এ ব্যপারে বদরগঞ্জ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা কাশপিয়া তাসরিনের সাথে মুঠোফোন কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে কল রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ আসনের (রংপুর-২) সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক বলেন, ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্যই প্রধানমন্ত্রী এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছেন। যদি প্রকৃত কোনো ভূমিহীন সরকারি এই ঘর বরাদ্দ না পেয়ে থাকে সেটিও দেখা হবে। একই সঙ্গে বিত্তবানরা ঘর পেয়ে থাকলে ইউএনও বরাবরে অভিযোগ করা হলে আমরা অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধেও ব‍্যবস্থা নেব। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে