এক বছর আগে পেটের দায়ে প্যাডেল রিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমে ছিলেন শাহিদা (৪০)। কিন্তু প্যাডেল রিকশা চালাতে যে শক্তি প্রয়োজন, সেই শক্তি শরীরে না থাকায় বেশি দিন পেরে ওঠেননি তিনি। তাই এবার অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। বৃহস্পতিবার (১০ নভেম্বর) রাতে তাকে মুন্সীগঞ্জ শহরে অটোরিকশা চালাতে দেখা গেছে। 

শাহিদা মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার গজারিয়াকান্দি গ্রামের মৃত নুর হোসেনের মেয়ে। বর্তমানে তিনি মায়ের সঙ্গে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগিনী গ্রামের আদর্শ গুচ্ছগ্রামে বসবাস করেন। 

জানা গেছে, শাহিদার জন্মের তিন বছর পর মারা যান তার বাবা নুর হোসেন। বাবার কোনো সম্পদ না থাকায় মা রানু বেগমের আশ্রয় হয় রাস্তার পাশে। সদর উপজেলার সমপাড়ায় রাস্তার পাশে ঘর তুলে বসবাস করতে শুরু করেন তারা। সেখানেই বেড়ে ওঠেন শাহিদা ও তার ভাই বেলাল। অভাবের তাড়নায় শাহিদার বয়স যখন ৮-৯ বছর, তখন থেকেই মায়ের সঙ্গে বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কাজ করতে শুরু করেন।  ১৪-১৫ বছর বয়সে পাশের রামপাল গ্রামের কামরুল ইসলাম বাবুর সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বিয়ের তিন বছর পর তার ঘরে জন্ম নেয় কন্যা সন্তান। মেয়ের জন্মের এক বছর পর হঠাৎ করে উধাও হয়ে যান শাহিদার স্বামী বাবু। বিপাকে পড়েন শাহিদা। পরে একমাত্র মেয়ে সুমাইয়াকে নিয়ে আশ্রয় নেন মায়ের সরকারিভাবে পাওয়া মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগিনী গ্রামের আদর্শ গুচ্ছগ্রামের একটি ঘরে।

সেখানে থেকে আবার অন্যের বাসায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু বাসায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। জীবিকার তাগিদে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে। কিন্তু দুবাইতে এক মাস থেকে ফিরে আসেন দেশে। আবার শুরু করেন বাসা-বাড়িতে কাজ। তবে নিয়মিত কাজ না পাওয়ায় এক বছর আগে রিকশা চালাতে শুরু করেন শাহিদা। কিন্তু রিকশার প্যাডেল চাপা কঠিন হয়ে যায় তার জন্য। পরে রিকশা চালানো ছেড়ে কাজ নেন এক কারখানায়। কিন্তু হঠাৎ করে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েন তিনি। মানুষের দ্বারস্থ হয় সাহায্যের জন্য। কিন্তু শুনতে হয় নানা কথা। মেয়ে সুমাইয়ার ভরণপোষণ ঠিকমতো দিতে পারছিলেন না তিনি। তাই বাধ্য হয়ে মেয়ে সুমাইয়াকে বিয়ে দেন শাহিদা।

তিন মাস আগে হঠাৎ করে ফিরে আসেন শাহিদার স্বামী কামরুল ইসলাম বাবু। শাহিদা খুশি হয়ে স্বামীকে স্থানীয় একটি গ্যারেজ থেকে অটোরিকশা ভাড়ায় নিয়ে চালানোর জন্য দেন। কিন্তু স্বামী বাবু রিকশা চালিয়ে সাহিদার সংসারে খরচ দেওয়া তো দূরের কথা রিকশার গ্যারেজের ভাড়াই দিচ্ছিলেন না। স্বামী যা আয় করতেন তা নেশার পেছনেই ব্যয় হতো তার।

এ নিয়ে গ্যারেজ মালিকের কটূক্তি শুনতে হয় শাহিদাকে। গ্যারেজের রিকশা ভাড়া পরিশোধের জন্য চাপও আসতে থাকে। পরে শাহিদা স্বামীকে যে রিকশাটি ভাড়া নিয়ে দিয়েছিলেন সেই রিকশা নিয়ে নিজেই নেমে পড়েন রাস্তায়। গত ৪ নভেম্বর থেকে নিজেই রিকশা চালানোর ট্রেনিং নিতে শুরু করেন। দুই দিন শেখার পর এখন নিজেই রিকশা চালাচ্ছেন। গ্যারেজ মালিককে ৪০০ টাকা ভাড়া দিয়ে যা থাকে তাই নিয়ে বাড়ি ফিরছেন শাহিদা। বজ্রযোগিনীর গুচ্ছগ্রামে বৃদ্ধ মাকে নিয়েই তার সংসার। 

শাহিদা বলেন, জন্মের পরেই আমার বাবা মারা যান। বাবার কথা মনে নেই আমার। একটি রাস্তার পাশো ঘরের মধ্যেই বেড়ে উঠি আমি ও আমার ভাই বেলাল। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখি আমার মা অন্যের বাসায় কাজ করেন। মাকে সাহায্য-সহযোগিতার জন্য ৮-৯ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে অন্যের বাসায় কাজ করা শুরু করি। ১৪-১৫ বছর বয়সে মা আমাকে অভাবের তাড়নায় বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের সময় ভেবেছিলাম স্বামীর বাসায় সুখে থাকব। বিয়ের তিন বছর পর আমার একটি কন্যা সন্তান হয়। কন্যা সন্তান হওয়ার এক বছর পরই আমার স্বামী বাড়ি থেকে নিখোঁজ। পরে জানতে পারি অন্য মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করছে। ফিরে আসি আমি মায়ের সরকারিভাবে পাওয়া এই বজ্রযোগনি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসায়। মায়ের বাসায় থেকে অন্যের বাসায় কাজ শুরু করি। 

তিনি বলেন, অভাবের তাড়নায় বিদেশেও গিয়েছিলাম। কারখানায় কাজ করেছি, কিন্তু অভাব জন্মের পর হতে কখনো আমার পিছু ছাড়েনি। এখন বাধ্য হয়ে অভাবের তাড়নায় রিকশা চালাচ্ছি। রিকশা চালিয়ে দিনে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় করতে পারি । কিন্তু রিকশার মালিককে দিতে হয় ৪০০ টাকা।  ২০০ থেকে ৩০০ টাকা থাকে। এ দিয়ে ভালোভাবে সংসার চলে না আমার। যদি নিজের একটি রিকশা থাকতো তাহলে হয়তো উপার্জনের সব টাকা আমার থাকতো। এতে সংসারটা ভালোভাবে চালাতে পারতাম।

শাহিদার প্রতিবেশী গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা গ্রাম পুলিশ তাসলিমা বেগম বলেন, শাহিদা আমার অনুপ্রেরণায়  রিকশা চালাচ্ছে। প্রথমে ওকে আমি রিকশা চালানো শিখতে এক লোকের কাছে নিয়ে যাই।  পরে দুদিন শিখে এখন ভালোভাবেই রিকশা চালাচ্ছে শাহিদা। ওর স্বামী কোনো খোঁজখবর নেয় না। তাই রিকশা চালাতে বাধ্য হয়েছে। 

গুচ্ছগ্রামের অপর বাসিন্দা সুফিয়া বলেন, আমরা একসঙ্গে বসবাস করি। শাহিদা কিছু দিন আগে ওর স্বামীকে ‌গাড়ি নিয়ে দিয়েছিলেন চালানোর জন্য।  কিন্তু স্বামী ওকে সংসার খরচ এমনকি রিকশা ভাড়া না দিয়ে নেশা করেন। তাই অন্যের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া রিকশা এখন নিজেই চালাচ্ছেন। 

গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা মোবারক হোসেন বলেন, প্রায় ২০ বছর আগে পাশের রামপাল গ্রামের বাবুর সঙ্গে বিয়ে হয় শাহিদার। তারপর বাবু বরিশালের এক মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করেন। এদিকে শাহিদা স্বামীর বাড়ি থেকে ফিরে মায়ের সঙ্গে গুচ্ছগ্রামে বসবাস করতে থাকেন।


প্রতিবেশী গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা রাবিয়া বেগম বলেন, ওর স্বামী ওর খোঁজখবর নিত না। ওর জীবনটাই কষ্টের। তাই বাধ্য হয়ে সংসারের হাল ধরার জন্য রিকশা হাতে তুলে নিয়েছে। 

শাহিদার মা রানু বেগম (৭০) বলেন, অভাবের তাড়নায় খুব সকালে রিকশা নিয়ে বের হয় শাহিদা। ফেরে অনেক রাতে। আমি সন্ধ্যার পর  বাড়ির পাশের রাস্তায় এসে বসে থাকি আমার মেয়ে কখন আসবে। আসার পর মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফি। আমি সব সময় রাত হয়ে গেলে ওকে নিয়ে চিন্তায় থাকি।

এ বিষয়ে বজ্রযোগিনী ইউনিয়ন পরিষদের ৬নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন ইমরান বলেন, শাহিদা খুবই অসহায় নারী।  আমি তাকে অনেকবারই  সাহায্য-সহযোগিতা করেছি। বেসরকারিভাবে বিত্তবানরা আমার এলাকায় কোনো সাহায্য-সহযোগিতা দিলে আমি তা শাহিদা ও তার মা রানু বেগমকে দেই। ভবিষ্যতেও তাদের সাহায্য করবো। 

ব.ম শামীম/আরএআর