সোনা মিয়া (৭০)। দুরন্ত কৈশোর থেকে জীবনের পড়ন্ত বিকেল, পুরো সময়টাই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সীমান্তবর্তী নাফ নদীতে। এই নদীতে মাছ শিকারের ওপর ভর করেই জীবনের প্যাডেল ঘুরেছে সোনা মিয়ার। আর সেই নদীতে হঠাৎ মাছ  শিকারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় ২০১৭ সালে। এরপর থেকেই থমকে যায় সোনা মিয়ার জীবন। অধিকাংশ সময় চুলোয় আগুন জ্বলে না। তাই ভাতের অভাব আর বিনা চিকিৎসায় কাটছে তার জীবন। এখন জীবনপ্রদীপ নিভে গেলেই কেবল সোনা মিয়ার শান্তি। এই গল্প শুধু সোনা মিয়ার নয়, কক্সবাজারের টেকনাফে নাফ নদীতে মাছ শিকারের সঙ্গে জড়িত ১০ হাজার জেলের।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ঢল ও ইয়াবা পাচারের অজুহাতে বাংলাদেশ-মিয়ানমারকে ভাগ করা নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ করে দেয় সরকার। এরপর থেকেই অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছে জেলেদের।

নদীর পাড়ের জেলেরা জানায়, তাদের পূর্বপুরুষ সূত্রে পাওয়া একমাত্র পেশা মাছ ধরা। কিন্তু হঠাৎ মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। স্থানীয় শ্রম বাজারও রোহিঙ্গারা দখল করায় সবদিক থেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তারা। অর্থাভাবে তাদের বেঁচে থাকাটাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে ভাতের অভাব দূর করতেই চিন্তা করতে হয়, সেখানে সন্তানদের পড়াশোনা করানোর কথা ভাবতে পারেন না তারা। আর রোগ হলে তো থাকতে হয় চিকিৎসাহীন।

স্থানীয় জেলে সিরাজুল ইসলাম বলেন, নাফ নদীর কিনারায় বসতি হওয়ায় বাপ-দাদার আমল হতেই আমাদের পরিবার মাছ শিকার করেই সংসার চালিয়ে এসেছে। নাফ নদীতে সব সময় পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যায়। তাই মাছ শিকার ছাড়া অন্য কোনো পেশায় অভ্যস্ত হয়নি। এখনও নতুন পেশায় অভ্যস্ত হতে না পেরে বিগত ছয়টি বছর আমাদের মতো শত শত জেলে পরিবার মানবেতর জীবন পার করছে। নাফ নদীর তীর ঘেঁষে থাকা অর্ধসহস্রাধিক পরিবারের দুঃখ-দুর্দশার কথা চিন্তা করে সরকার নাফ নদীতে মাছ শিকারের সুযোগ দিক।

আরেক জেলে আব্দুল হালিম বলেন, রোহিঙ্গাদের কথা সবাই চিন্তা করে কিন্তু আমাদের কথা চিন্তা করার কেউ নেই। ইয়াবার অজুহাতে নাফ নদীতে মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল কিন্তু এখনও কি ইয়াবা বন্ধ হয়েছে। উল্টো আরও বেড়েছে।

কমিল উল্লাহ নামে এক মাঝি বলেন, প্রায় ৬ বছর ধরে মাছ শিকার বন্ধ। তার মধ্যে তেমন সরকারি সহায়তাও পাইনি। এতোদিন আমরা কীভাবে চলছি সেটার খবর কেউ রাখেনি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাও বন্ধ। ঠিকমতো ছেলেমেয়েদের মুখে খাবারও দিতে পারি না। এক বেলা খেলে আরেক বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। কোরবানির ঈদ ছাড়া চোখে মাংস দেখি না। যদি সরকার নাফ নদীতে মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা তুলে না নেয় তাহলে আমাদের মৃত্যু ছাড়া আর কিছু করার নেই।

টেকনাফ উপজেলা হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, যে কারণে মাছ ধরা বন্ধ করা হয়েছিল সেই ইয়াবা পাচার এখনও বন্ধ হয়নি নাফ নদীতে। তাহলে কেন টেকনাফের ১০ হাজার জেলে না খেয়ে থাকবে? দ্রুত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

এদিকে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান বলেন, নাফ নদীর জেলেদের সহায়তার জন্য এখন পর্যন্ত আলাদা করে কোনো কর্মসূচি নেওয়া হয়নি। আমরা প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জেলেদের বিষয়টি অবগত করছি।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, নাফ নদীর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কোনো সুখবর নেই। বর্তমানে সীমান্ত পরিস্থিতি খুব উত্তপ্ত। এই মূহুর্তে নাফ নদী খুলে দেওয়া যৌক্তিক সময় না।

জেলেদের দাবি, নাফ নদীতে নিষেধাজ্ঞার ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও ১০ হাজার জেলের একবারও খোঁজখবর নেয়নি কোনো জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসন। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান রাষ্ট্রের কাছে উপেক্ষিত থাকা জেলে সম্প্রদায়।

এমজেইউ