বাংলাদেশে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে ছাদবাগান। নড়াইলেও দিনে দিনে এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সৌন্দর্য বর্ধনের পাশাপাশি বিনোদন, নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে জুড়ি নেই ছাদবাগানের। তাইতো ছাদবাগান করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন নড়াইলের গৃহিণী তনিমা আফরিন (৩৮)। 

নড়াইল শহরের কুড়িগ্রামে নিজেদের ‘অন্তি কটেজ‘ বাড়ির চারতলা ভবনের তিন হাজার বর্গফুট ছাদে স্বামীর নাজমুল হকের সহায়তায় গড়ে তুলেছেন মনোরম এক ছাদবাগান। নাজমুল হক একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য। ২০১৬ সালে শখের বসে কয়েকটি ফুল ও ফলের গাছ দিয়ে আফরিনের ছাদবাগান শুরু হলেও পরবর্তীতে তা বাণিজ্যিকভাবে রুপ নিয়েছে। তার শখ এখন নেশা ও পেশায় পরিণত হয়েছে।

চারতলা বিশিষ্ট বাড়িতে ঢুকতে গেটে বিশাল আকৃতির কাগজি ফুল ও ঝাউ গাছ যেন ছাদবাগান দেখতে স্বাগত জানায়। সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে দুধারে সারিবদ্ধভাবে ছোট ছোট টবে সাজানো সৌন্দর্য বর্ধনকারী গাছ।

সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠে ছাদের দরজা খুলতে চোখে পড়ে প্লাস্টিকের ব্যারেলে, মাটির চাড়িতে ও বিভিন্ন ধরনের টবে মাটি দিয়ে সাজানো সারিবদ্ধভাবে ফুল, ফল, ঔষধি, শাকসবজিসহ নানা জাতের ছোট বড় প্রায় ৬০০ গাছের সমাহার। যেটি দেখে ক্ষণিকের জন্য অনেকের মনে হবে এটি কোনো ছাদবাগান নয় বরং মাটির উপর তৈরি বাগান।

সবজির মধ্যে রয়েছে ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, কালো টমেটোসহ পাঁচ জাতের টমেটো, করলা, লাল শাক, সবুজ শাক, ডাটা, লাউ, সিম, মিষ্টি কুমড়া, আলু, ধনেপাতা, বারোমাসি সজনে, মশলার মধ্যে রয়েছে পিয়াজ, রসুন, আদা, চুইঝাল, তেজপাত, আলু বোখরা, লবঙ্গ, গোলমরিচ ও পাঁচ জাতের মরিচ ইত্যাদি।

ফলের মধ্যে রয়েছে আপেল, কমলা, আঙ্গুর, পাঁচ জাতের মালটা, বারোমাসি আমড়া, মিষ্টি তেতুল, তিন জাতের কলা, বারোমাসি থাই পেয়ারা, সীডলেস পেয়ারা, অস্ট্রেলিয়ান পাকিস্তানিসহ আট জাতের বেদানা, দেশি ডালিম, মিশরীয় তীন ফল (ডুমুর) সহ বারো জাতের তীন ফল, বাতাবি লেবু,  কাগজী লেবু, সীডলেস লেবু, পিস ফল, লাল ও সাদা জাতের সহ চার জাতের ড্রাগন ফল , সাদা ও লাল জাতের মেওয়া ফল, নাশপতি,  গোলাপজাম, দুই ধরনের লঙ্গনফল, রয়েল ফল, পিচফল, কাউফল, দুই জাতের মালবেরি, কামরাঙ্গা, করমচা, কাশমেরী আপেল কুল, বাউ আপেল কুল, নারকেলী কুল, আপেল কুল, আম- ব্যানানা ম্যাংগো, বারী-১১ আম, কিউ-জাই, বারোমাসি কাটিমন আম, পালমাল আম, স্ট্রবেরি পেয়ারা, মাধুরী পেয়ারা, কদবেল, দুই ধরনের ছবেদা, দুই ধরনের কদবেল, পেঁপে, ফিলিপাইন আঁখসহ জানা অজানা হরেক রকমের ফল।

ফুলের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন ধরনের গোলাপ, ক্যামেলিয়া, জবা, এ্যাডেনিয়াম, জুই, করবী, বেলি, হাসনাহেনা, ব্লেডিং হার্ট, কৃষ্ণচুড়া, মালঞ্চ, কালঞ্চ, শাপলা, শিউলি, কাটা মুকুট, নন্দিনী, রঙ্গন, গ্রাউন্ড অর্কিডসহ নানা জাতের ঋতু ভিত্তিক ফুল।

শোভাবর্ধনের জন্য রয়েছে সাইক্রাস, বিভিন্ন জাতের  মানিপ্লান্ট, পাতাবাহার, ইঞ্চি প্লান্ট, স্নেক প্লান্ট, ঝাউগাছ, পাটট্রি ইত্যাদি।

ঔষধি গাছের মধ্যে রয়েছে ক্যান্সার প্রতিরোধক ননী ফল, আদা, তুলসী, বাসক,  নীম, অ্যালোবেরা, শ্বেতচন্দন, পুদিনা পাতা, লজ্জাবতী, ধুতরা, থানকুনি, স্বর্ণলতা, অর্জুন, পাথরকুচিসহ ইত্যাদি।

গাছগুলো কলমের হওয়ায় একেবারেই ছোট অবস্থায় এবং অল্পদিনে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফুল ও ফল ধরছে। দৃষ্টি নন্দন আদর্শ ছাদ বাগানের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে সম্পূর্ণরূপেই কীটনাশক মুক্ত পদ্ধতিতে চাষাবাদ।

তনিমা আফরিনের দুই মেয়ে প্রিয়ন্তি ও রুপন্তি ঢাকা পোস্টকে বলেন, মায়ের ছাদ বাগান ছোটবেলা থেকে দেখছি। পড়াশোনার পাশাপাশি বাগানে এসে গাছ ফুল-ফলের যত্ন নেই, মাছদের খাবার দেই। আমাদের বন্ধুরা আমাদের বাগান দেখতে আসে। বাগানে হাঁটাহাঁটি করতে থাকতে খুব ভালো লাগে, মন ভালো হয়ে যায়।

বাগান দেখতে এসে এক গৃহিণী ঢাকা পোস্টকে বলেন, তনিমা আপুর সাথে পরিচয় আমার প্রায় বছর খানেকের মত। আপুর ছাদবাগানটা অনেক সুন্দর। অনেক অনেক গাছের সমারোহ। আপুর ছাদবাগানটা যেমন সুন্দর ওনার মনটা ও তেমনি অনেক ভাল। আমি তনিমা আপুর বাগানে প্রায় আসি, এখানে আসলে মনটা অনেক ভাল হয়ে যায়।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাজমুল হাসান লিজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও আমাদের অবারিত কৃষি জমি দিন দিন কমে যাচ্ছে। নগর জীবনে বসবাসরত মানুষের মধ্যে ছাদবাগান দিন দিন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ছাদবাগানে ফুল-ফল, ঔষধি, শাকসবজি সব ধরনের গাছ লাগানোতে আমাদের যেমন অক্সিজেন সরবরাহ করছে, পাশাপাশি বাজারের বিষযুক্ত ফল, শবজির পরিবর্তে নিজেদের বাগানের বিষমুক্ত খাবার পাচ্ছি। আমাদের শহরে ছাদবাগান বেশ ছড়িয়ে পড়ছে।

ঢাকা পোস্টের সাথে আলাপচারিতায় ছাদ বাগানি তনিমা আফরিন বলেন, আমার আম্মা তহমিনা হুসাইন একজন কৃষি উপ-সহকারি কর্মকর্তা। মায়ের থেকে দেখে ছোটবেলা থেকেই গাছের প্রতি একটা গভীর ভালবাসার সৃষ্টি হয়। প্রথমে শখের বসে ছাদে সৌন্দর্য বর্ধন ও সময় কাটানোর জন্য ছাদে ফুল গাছ লাগাই। পরে আম্মার উৎসাহ, সহযোগিতা ও পরামর্শে নানা ধরনের ফল, সবজি ও ঔষধি গাছ লাগাই। পরবর্তীতে এ ছাদবাগান সমৃদ্ধ করার ব্যাপারে আমাকে বড় ধরনের সহযোগিতা ও উৎসাহ দেন এক বড়ভাই।

ছাদ বাগানের আয় ব্যয় সম্পর্কে তিনি বলেন, শখ থেকে নেশা এবং পরবর্তীতে পেশায় রুপ নিয়েছে আমার এই ছাদ বাগান। সারাদেশে অনলাইনের মাধ্যমে শুধু কলম চারা বিক্রি করে বাৎসরিক দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা উপার্জন হয় এই বাগান থেকে। আর সর্বমোট আয় কেমন সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষমুক্ত বিশুদ্ধ ফল ও সবজি বাজার থেকে কিনতে গেলে বেশ অর্থ খরচ হতো, আসলে সর্বমোট আয় গণনার বাইরে। শীতকালে কোনো সবজি বাজার থেকে কেনা লাগে না । বাগান থেকেই মোটামুটি সব ধরনের বিষমুক্ত ফল ও সবজির চাহিদা পূরন হয় আমাদের। নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী ও নিকট আত্মীয়দের দিয়ে থাকি। বিশেষ করে গরীবদের মাঝে এ বাগানের ফল ও সবজি বিলিয়ে বেশি আত্মতৃপ্তি পাই।

কাজের অনুপ্রেরণা ও স্বীকৃতি স্বরুপ বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ১৪২৬ এ ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছি গত ১২ অক্টোবর। এটা আমার জন্য অনেক গর্বের বিষয়। সেজন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই প্রধানমন্ত্রীসহ পদক সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি। আমার স্বামী, সন্তান, আম্মা, আমার প্রতিবেশীরাসহ ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও সার্বিক সহযোগিতায় বাগানটা সুন্দর করে সাজাতে পেরেছি।

তিনি আরও বলেন, অন্যদের বাগান করার ব্যাপারেও পরামর্শ ও কলম চারা বিনামূল্যে দিয়ে থাকি। আমি চাই সকলে ছাদ বাগানে উৎসাহিত হোক। অলস সময় পার না করে ছাদ বাগানের মাধ্যমে যেমন অর্থ উপার্জন হবে অন্যদিকে নিজেদের বিষমুক্ত ফল ও সবজির চাহিদা ও পূরণ হবে।

নড়াইল সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রোকনুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে যারা ছাদ বাগানি আছেন তারা একই সাথে তাদের বাগানে ফল, ফুল,  সবজি, ভেষজ উদ্ভিদ চাষ করার মাধ্যমে যেমন তাদের অবসর সময় কাটান, পাশাপাশি একই সাথে এগুলোর সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি স্বাদ-গন্ধ উপভোগ করতে পারেন। ছাদ বাগানের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। ছাদবাগানে সব ধরনের গাছ লাগানো সম্ভব। তনিমা আফরিন একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা, নড়াইলের ছাদ বাগানিদের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি সবার জন্য এক অনুপ্রেরণা।

নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক দীপক কুমার রায় বলেন, বিশেষ করে কৃষিতে নারীর ভূমিকা শীর্ষক অবদান রাখায় তনিমা আফরিন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পেয়েছেন। তার দেখাদেখি এলাকায় ছাদবাগান সম্প্রসারিত হচ্ছে। ছাদবাগান  মূলত অবসর সময়ে বিনোদনের একটি উপায়। এখান থেকে আর্থ সামাজিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে।  অত্যন্ত রুচিশীল মার্জিত এই ছাদ বাগানটি নড়াইলের একটি উজ্জ্বল প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ। সরকারের দিক নির্দেশনা মোতাবেক নড়াইলের অনাবাদি পতিত জমিতে চাষাবাদের আওতায় আনার জন্য কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতা দিচ্ছি। পাশাপাশি  ছাদবাগানে উৎসাহিত করতে ইতোমধ্যে প্রায় শতাধিক পরিবারের কৃষক কৃষাণীদের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করছি। যার মাধ্যমে এই লাভজনক কৃষি ব্যবসা যেন তাদের আর্থ সামাজিক অবস্থা উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।

সজিব রহমান/আরকে