‘বাবারে আমরা গরিব মানুষ। কষ্ট করে লেখাপড়া শিখাইছি বাচ্চাদের মানুষ করারই জন্য। বাচ্চারা ভবিষ্যতে মানুষ হবে। ওরা করি মিলি খাবে। আমাদের কপালে যা হয় হইবে। সব আশা আজকে আমার ধুলিসাৎ হয়ে গেল। বাবার আশা ছিল বড় হবে, যখন ভার্সিটির লেখাপড়া শেষ হবে চাকরি পাববে,  সে রকম যদি হয় ভার্সিটির প্রভাষক হবে। আশা-স্বপ্ন সব শ্যাষ হয়া গেল। সরকার যদি এই অভাবের সংসারে সহযোগিতা করে তবুও ছেলে তো চিরদিনের জন্য চলে গেল। ছেলে তো আর ফিরে আসবে না।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জগন্নাথ হলের সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ভবনের ওপর থেকে পড়ে নিহত শিক্ষার্থী লিমন কুমার রায়ের মা লিলা রানী রায়।

এর আগে বুধবার (২৩ নভেম্বর) সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ১০ তলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন লিমন। সকাল সাড়ে ১০টায় গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

লিমন নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের মাগুড়া ইউনিয়নের মাগুড়া দোলাপাড়া এলাকার প্রতাপ চন্দ্র রায়ের ছেলে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (আইইআর) তৃতীয়  বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। থাকতেন জগন্নাথ হলের সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ভবনের একটি কক্ষে। 

লিমন ২০১৭ সালে মাগুড়া শিঙ্গের গাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১৯ সালে রংপুরের কারমাইকেল কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস করেন।  দুই পরীক্ষাতে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন তিনি। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন লিমন।

লিমন সব সময় মানুষের মঙ্গলের কথা চিন্তা করতেন। করোনাকালে লকডাউনের সময় গ্রামের বাড়িতে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি একটি পাঠশালা গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে পড়াতেন।

লিমনের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বাবা- মা আহাজারি করছেন। আত্মীয়-স্বজনও শোকে মূহ্যমান।  তার মৃত্যুর খবরে তার বাড়িতে এসে ভিড় করেছেন প্রতিবেশীরা।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে লিমনের বাবা প্রতাপ চন্দ্র রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কী আর বলবো, ছেলেকে তো কষ্ট করে লেখাপড়া শিখাইতেছি, পরিশ্রম করতেছি। সরকারের কাছে দাবি- আরো তো  একটা ছেলে একটা মেয়ে আছে, ওদেরকে যেন কিছু সহযোগিতা করে। এটাই আমার সরকারের কাছে আশা।

লিমনের ছোট ভাই সুমন চন্দ্র রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, সকালে স্কুলে যাওয়ার পর দাদার বন্ধু আমাকে ফোন দিয়ে খবর জানায় যে দাদা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। এটা শোনার পর আর থাকতে পারলাম না স্কুলে। তারপর বাড়িতে এসে কিছুক্ষণের মধ্যে শুনি যে দাদা মারা গেছেন। আমার দাদার স্বপ্ন ছিল আমি বড় হয়ে  ইঞ্জিনিয়ার হই। ছোট বোনটাকে তিনি ডাক্তার বানাতে চেয়েছিলেন। তা তো আর হলো না। এখন আমরা কীভাবে চলবো।  সরকারের কাছে একটা মিনতি- আমাদের দিকে একটু দেখেন, তাহলে আমাদের দাদার স্বপ্ন আমরা পূরণ করতে পারবো।

প্রতিবেশী নারায়ণ চন্দ্র রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, লিমন খুব মেধাবী ছাত্র ছিল। তাকে নিয়ে গ্রাম ও তার পরিবারের সবার একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। সে মানুষের মতো মানুষ হলে আগামী দিনের গ্রামের সবার মুখ উজ্জ্বল হতো। তার বাবা রিকশা চালিয়ে তার পড়াশোনার খরচ চালাতো। সে ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় ছিল। সবার আশা ছিল লেখাপড়া শেষ হলে তার ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়ায় সমস্যা হবে না।

মাগুড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আকতারুজ্জামান মিঠু ঢাকা পোস্টকে বলেন, লিমনের বাবা খুবই অসহায়, গরিব। রিকশা চালিয়ে তার লেখাপড়ার খরচ চালাতো। তাকে নিয়ে বাবা-মায়ের অনেক আশা ছিল। সে লেখাপড়া শেষ করে সংসারের হাল ধরবে। তার মধ্যে তো এই দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় খবরটা শুনে এখানে ছুটে আসছি। চেষ্টা করছি অক্ষত অবস্থায় তার মরদেহটা গ্রামে নিয়ে আসার। তার পরিবারের পাশে আমি সবসময় আছি। পাশাপাশি সরকার এই অসহায় পরিবারটিকে যেন একটু দেখে।

আরএআর