‘আল্লাহর রহমত আর মেয়রের সুচিন্তার কারণে সিটি কর্পোরেশনের ভিতরোত স্বাস্থ্যসেবার মান ভালোই হইছে। এ্যালা সিটির অফিসোত আসিয়্যা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসি থাকা নাগে না। কয়দিন ধরি শরীরট্যা মোর ভালো যাওছে না। ওই তকনে কমিশনারের পরামর্শে সিটিত আসিয়্যা ডাক্তার সাইবোক দেকানু। বিনা টাকাতে ডাক্তার মোক দেকিয়া কাগজোত কয়টা ওষুধ নেকি দিছে। ডাক্তার সাইবের ব্যবহার খুব ভালো।’

কথাগুলো বলছিলেন রংপুর মহানগরীর ২ নং ওয়ার্ডের গোয়ালুপাড়ার সোহরাব মিয়া। ষাটোর্ধ্ব এই দিনমজুর কয়েক দিন ধরে শীতজনিত রোগে ভুগছিলেন। তার এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কালাম আজাদের পরামর্শে সিটি কর্পোরেশনে দায়িত্বরত চিকিৎসকের কাছে এসেছিলেন তিনি। সোমবার সকালে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে।  

সোহরাব মিয়ার মতো অনেক বয়স্ক নারী-পুরুষ সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সিটি কর্পোরেশন থেকে বিনা মূল্যে চিকিৎসকের পরামর্শ ও চিকিৎসাপত্র গ্রহণ করছেন। সিটি মেয়র ও প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এ ধরনের সেবায় উপকৃত হচ্ছেন নগরীর দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ।

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্যসেবার প্রশংসা শুধু সোহরাব মিয়ার মুখেই নয়, প্রশংসা করছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। কারণ সারা দেশের অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনের তুলনায় এই সিটি কর্পোরেশন জনবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে এগিয়ে আছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির মতো বড় দুর্যোগের সময়ে সিটি মেয়র, ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা ছুটে বেরিয়েছেন সবখানে।  

নগর ভবনের স্বাস্থ্য বিভাগে করোনার প্রতিষেধক টিকা নিয়ে বাইরে বাগান চত্বরে বসে খানিকটা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন রুমানা পারভীন। রংপুর নগরীর ৪ নং ওয়ার্ডের বালাকুমার গ্রামের এই বাসিন্দা আগে দুটি ডোজ নিয়েছেন। বাকি থাকা তৃতীয় ডোজটি নেওয়ার জন্য সিটি কর্পোরেশন ভবনে এসে পরিবেশ দেখে মুগ্ধ তিনি। রুমানা পারভীন বলেন, করোনা মহামারির সময়ে আমার বাড়ির পাশের একজন করোনা আক্রান্ত রোগীকে সিটি মেয়র বাসায় গিয়ে ফলমূল দিয়ে এসেছিল। আমরা তো ভয়ে ছিলাম। অথচ কাউন্সিলর, মেয়র, স্বাস্থ্যকর্মীরা নির্ভয়ে আমাদের জন্য কাজ করেছেন। আজ সিটি কর্পোরেশনে এসে ভালো লাগছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগর ভবনে গর্ভবতী মা, কিশোরী, বয়স্ক মহিলা, শিশুরা ছাড়াও সাধারণ মানুষও এখন নিয়মিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। নগরবাসীর স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন রকম কার্যক্রম পরিচালনা করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। জরুরি রোগীদের দ্রুত সেবা প্রদানে নতুন অ্যাম্বুলেন্স সংযোজন করা ছাড়াও সাতমাথা, নিউ জুম্মাপাড়া, আশরতপুর, গণেশপুরে স্থাপিত নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে বাড়ানো হয়েছে সেবার পরিধি।

সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে সেবার আলো সবার কাছে ছড়িয়ে দিতে লাইট হাউস পরিচালিত রংধনু চিহ্নিত নগর মাতৃসদন ও নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গর্ভকালীন সেবা, প্রসবকালীন সেবা (নরমাল ও সিজারিয়ান), প্রসব পরবর্তী সেবা, মাসিক নিয়ন্ত্রণ সেবা, গর্ভপাত পরবর্তী সেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি সেবা, সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, সাধারণ রোগের চিকিৎসা, স্বাস্থ্য শিক্ষা, রোগ নিরুপণ সেবা, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদান করে আসছে। শুধু তাই নয়, হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষজনকে রেড কার্ডের মাধ্যমে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবাও প্রদান করা হয়।

সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে, ২০১৮-২০২২ অর্থবছরে রংপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮২৬ জনকে কোভিড-১৯ এর ভ্যাক্সিন প্রদান করা হয়। ভিটামিন এ খাওয়ানো হয়েছে ৮ লাখ ৭ হাজার ৮০৪ শিশুকে। ৪ লাখেরও বেশি মানুষের মধ্যে খাবার স্যালাইন বিতরণ করা হয়েছে। ৮৮ হাজার ৩৯২ জন মা ও শিশুকে ইপিআই টিকার আওতায় আনা হয়েছে। কৃমিনাশক ট্যাবলেট ৫ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জনকে খাওয়ানো হয়েছে।

একই সময়ে ২১ হাজার ৯০০ জনকে জলাতঙ্ক ভ্যাক্সিন প্রদান করা হয়েছে। যক্ষ্মার (টিবি) প্রতিষেধক হিসেবে ৯০ হাজারেরও বেশি মানুষকে ব্যাসিলাস ক্যালমেট-গুয়েরিন (বিসিজি) টিকা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া ২৪ হাজার ৩৬৫ জনকে পুষ্টির আওতায় আনার পাশাপাশি নগরীর বিভিন্ন বস্তিতে ১ হাজার ৪১২টি টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে।  

রংপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকার মধ্যে ‌১টি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, সরকারি ক্লিনিক ৪টি, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল রয়েছে ৪টি। সিটি করপোরেশন কর্তৃক পরিচালিত ৫টি হাসপাতাল রয়েছে। 

রংপুর মহানগরীর ২৭ নং ওয়ার্ডের রবার্টসনগঞ্জ এলাকার কেজি কাপড় বিক্রির মার্কেট সংলগ্ন অস্থায়ী স্যাটেলাইট ক্লিনিকে সরেজমিনে দেখা যায় বিভিন্ন বয়সী মানুষের ভিড়। সেখানে পুরুষের তুলনায় সেবা প্রত্যাশী নারীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। প্রতি বুধবার এই ক্লিনিকে সেবা নেন আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা। রেড কার্ডে বিনা মূল্যে সেবাও মিলছে সেখানে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি স্বল্পমূল্যে সেবা পেয়ে খুশি উপকারভোগীরা।

সেখানে কথা হয় সেবাগ্রহীতা মেরিনা ও বিথী নামে দুই মধ্য বয়সী নারীর সঙ্গে। তারা দুজন জানান, প্রতি সপ্তাহে এলাকার অনেকেই স্যাটেলাইট ক্লিনিকে এসে সেবা নেন। এর জন্য নামমাত্র মূল্য দিতে হয়। তবে যাদের রেড কার্ড রয়েছে তাদের কোনো টাকা দিতে হয় না। এই ক্লিনিকে প্যাথলজিক্যাল সেবাও দেওয়া হয় বলে জানান তারা।  

নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সার্ভিস প্রমোটর (এসপি) মাহাবুবা আকতার বলেন, আমরা দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে কাজ করছি। বিশেষ করে যারা একেবারেই স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে অসচেতন, তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি নগরবাসীর প্রত্যাশিত স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়নই আমাদের লক্ষ্য।  

নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্যারামেডিক চিকিৎসক হাসি খাতুন বলেন, প্রতিটি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমাদের অভিজ্ঞ কয়েকজন চিকিৎসক রয়েছে। তাদের পাশাপাশি আমরা নির্ধারিত নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বাইরে স্যাটেলাইট ক্লিনিকের মাধ্যমে সেবা দিচ্ছি। ১০টি সেবা একেবারেই বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে।

নগরবাসীর স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে জানতে চাইলে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কামরুজ্জামান তাজ বলেন, অন্যান্য সেবার পাশাপাশি সারা দেশের মধ্যে করোনাকালীন নমুনা সংগ্রহ ও টিকাদান কার্যক্রমে রংপুর প্রথম অবস্থানে ছিল। সব মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে আমরা সবরকম চেষ্টা করেছি। আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা পাড়া-মহল্লায় ছুটে বেরিয়েছেন। ভ্রাম্যমাণ টিকাদান কার্যক্রমের মাধ্যমে বয়স্ক নারী ও পুরুষদের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। অসুস্থদের বাসায় বাসায় দিয়ে ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার সঙ্গে স্বাস্থ্যসম্মত ফলমূল বিতরণ করেছি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের নগরীর আয়তন ও জনসংখ্যা অনুপাতে সিটিতে স্বাস্থ্য বিভাগে লোকবল কম। বর্তমানে আমরা সিটির ৭৭ জনের পাশাপাশি ইউনিসেপের ৫৩ জন কর্মীকে নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছি। করোনার সময়ের মতো এখনো আমরা স্বাস্থ্য সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছি।

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, আমরা সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সমান সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে আসছি। সিটি কপোরেশন ভবনে এসে কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সেজন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজেও খোঁজখবর রাখছি। এখানে একজন ধনীর ছেলে-মেয়ে যে সেবা পাচ্ছে, একেবারেই হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানরাও এসে একই সেবা পাচ্ছেন। সেবা প্রদানের ব্যাপারে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা অনেক বেশি সজাগ।

বিদায়ী এই মেয়র বলেন, করোনাকালীন মানুষ ভয়ে ঘর থেকে বের হতো না। তখন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত আমাদের কর্মীরা নিরলসভাবে করোনার নমুনা সংগ্রহ করে আসছে। বাংলাদেশের কোনো সিটি কর্পারেশন এই কাজটা করতে পারেনি। একমাত্র আমরাই করোনার নমুনা সংগ্রহ করেছি, লাখ লাখ মানুষকে টিকা দিয়েছি। করোনায় কারো মৃত্যু হলে জানাজার ব্যবস্থা করেছি। স্বাস্থ্যখাতে আমাদের অনেক সফলতা রয়েছে। তবে আমাদের জনবল বাড়লে আরও বেশি সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।  

তিনি আরও বলেন, অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনের চাইতে আমাদের সেবার মান অনেক ভালো। বর্তমানে নগরীর ৩৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৫টি ওয়ার্ডে কর্ম পরিধি রয়েছে। বাকি ওয়ার্ডগুলোতে সিভিল সার্জনের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে আমরা চাচ্ছি সবগুলো ওয়ার্ডে যে কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে, সেগুলো সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে যুক্ত করতে। এটা সম্ভব হলে আমরা সুন্দরভাবে মনিটরিং করে স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে আরও একধাপ এগিয়ে যাবো।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি