পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে শৈশবেই দুটি পা অচল হয়ে যায় নেত্রকোণার দুর্গাপুরের নোপালি চাম্বুগংয়ের। জীবন সংগ্রামের শুরু তখনই। এক সময় যিনি ছিলেন করুণার পাত্র, সেই নোপালিই এখন পরিবারের অবলম্বন। নিজে স্কুলের চৌকাঠ মাড়াতে না পারলেও কার্পেট কারখানায় কাজ করে উপার্জিত টাকায় এক বোনকে পড়িয়েছেন মাস্টার্স পর্যন্ত। নিজে হয়েছেন স্বাবলম্বী। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করা নোপালির মুখে তাই এখন বিজয়ের হাসি।

নোপালির মতো প্রতিবন্ধী সাবিনা আক্তার, রহিমা বেগম, বাবলি আক্তারসহ আরও অনেকেই কাজ করছেন ময়মনসিংহের প্রতিবন্ধী আত্মউন্নয়ন সংস্থার কার্পেট কারখানায়। যাদের কেউ আবার শারীরিক অক্ষমতার কারণে নিজের পরিবার থেকেই বিতাড়িত। কিন্তু পরিশ্রম আর হস্তশিল্পের ছোঁয়ায় জীবন সংগ্রামে জয়ী তারা, হয়ে উঠেছেন পরিবারের ভরসা। নগরীর কাঁচিঝুলি এলাকায় সেই কারখানায় তাদের হাতের তৈরি কার্পেট, শতরঞ্জি, ব্যাগসহ গুণেমানে সেরা নানা পণ্য বিক্রি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্সসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

এসব অসহায় মানুষের আত্মকর্মসংস্থানের পেছনের কারিগর আরেক সংগ্রামী প্রতিবন্ধী নারী শেফালি আক্তার। তিনি এই সংস্থাটির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল পেছনের গল্প। ১৯৯৭ সালে সুইডেনের নাগরিক ব্রাদার ফ্রাঙ্ক প্রতিবন্ধীদের কর্মমুখী করতে ময়মনসিংহ নগরীর কাঁচিঝুলি টাউন হল এলাকায় চালু করেন প্রতিবন্ধী কমিউনিটি সেন্টার। সেখানে কার্পেট-শতরঞ্জির বুননের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২০০৪ সালে এখানে কাজ শেখেন সদরের কিসমত গ্রামের ইদ্রিস আলীর মেয়ে শেফালি আক্তার। রপ্ত করেন নানা ধরনের কাজ। কিছু দিন পর ব্যবস্থা হয় কর্মসংস্থানেরও।

প্রতিবন্ধী অন্য নারীদের ভাগ্য ফেরাতে ২০১৯ সালে নগরীর কাঁচিঝুলি মোড়ে একটি বাড়িতে গড়ে তোলেন প্রতিবন্ধী আত্মউন্নয়ন সংস্থা। সংস্থাটি ২০২০ সালে নগরীর কিসমত, তারাগাঁই, মির্জাপুর, রহমতপুর ও বেগুনবাড়ি এলাকায় আরও পাঁচটি শাখা চালু করে। এগুলোতে কাজ করছেন দুই শতাধিক প্রতিবন্ধী নারী-পুরুষ ও শিশু। প্রত্যেকের জীবনের গল্পও অনেক কষ্টের। তবে তারা কষ্ট ঘুচিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার সংগ্রামে নিয়োজিত রয়েছেন।

নোপালি চাম্বুগং বলেন, আগে এলাকার মানুষজন বলতো হাঁটতে পারি না চলতে পারি না, কীভাবে দিন চলবে আমার। অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে সারা জীবন। কিন্তু কারও বোঝা হয়ে আমি থাকতে চাইনি। হাতের কাজ শিখে আজ আমি স্বাবলম্বী হয়েছি। প্রতিবন্ধিতা ও পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে আমি শৈশবে স্কুলে যেতে না পারলেও আমার বোনকে পড়াশোনা করাতে পেরেছি। এ সংস্থায় কাজ করে এখন সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করেই চলতে পারছি।

সাবিনা আক্তার নামে আরেক প্রতিবন্ধী নারী বলেন, আমি কারও ওপর নির্ভরশীল নই। কাজ করে রোজগার করি। উপার্জনের টাকায় বড় বোনকে বিয়ে দিয়েছি। নিজের খরচ নিজেই চালাই, পরিবারকেও সহযোগিতা করি।

সংস্থার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক শেফালি আক্তার বলেন, প্রতিবন্ধীরা সরকারিভাবে ভাতা পেলেও কর্মসংস্থানের সুযোগ তেমন নেই। আর ভাতা যা পায় তা দিয়ে মাসের খরচ চালানো যায় না। বাড়িতেই বসে থাকতে হয়। সেই চিন্তা থেকেই প্রতিবন্ধীদের স্বাবলম্বী করে তুলতেই আমাদের এই সংস্থাটির যাত্রা। যেন প্রতিবন্ধীরা সমাজের অবহেলার পাত্র হয়ে না থাকে। তাদের যেন সমাজে একটি মূল্যায়ন তৈরি হয়। তাতে আমরা অনেকটাই সফল হয়েছি বলে মনে করি।

তিনি জানান, আমাদের পণ্যগুলো গুণে-মানে খুবই ভালো। সেজন্য এগুলো রপ্তানি হচ্ছে। করোনার ধাক্কা সামলে এ বছর ছোট্ট এই কারখানা থেকে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১৫ লাখ টাকার পণ্য। আসছে বড় দিনে ইউরোপের বাজারে উপহার সামগ্রী হিসেবে বিক্রি হবে এখানকার তৈরি নানা পণ্য।

সমাজের বাকি সদস্যদের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপনের কথা থাকলেও সব অধিকার থেকেই বঞ্চিত এই প্রতিবন্ধীরা। জীবনের প্রতিটি ধাপেই ফুটে উঠেছে অবহেলার চিত্র। তবে ইচ্ছাশক্তির জোরে আর কাজের মাধ্যমে নোপালি-সাবিনারা দেখিয়েছে সুযোগ পেলে সমাজে বোঝা নয় বরং তারাও হয়ে উঠতে পারেন দেশের সম্পদ। দেশের অর্থনীতিতে রাখতে পারেন বিশেষ অবদান।

এসপি