‘আগে আমাদের মেসের নিয়মই ছিল প্রতি মাসে অন্তত একবার ভালো খাবার খাওয়া। অনেক মাসে দুই বারও হতো। ভালো খাবার বলতে গরু বা খাসির মাংস, পোলাও বা বিরিয়ানি। এখন পরিস্থিতি এমন হইছে যে দুই মাসেও একবার এমন ভালো খাবার বা স্পেশাল মিলের কথা ভাবতে পারি না। কারণ একটাই- হু হু করে মিলচার্জ বাড়ছে।’

কথাগুলো বলছিলেন ফরিদপুর শহরের পশ্চিম খাবাসপুর মহল্লার একটি ছাত্রনিবাসের বাসিন্দা শাকিল আহমেদ (২১)। তিনি ফরিদপুর শহরের সরকারি ইয়াছিন কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। গত দুই বছর ধরে তিনি ফরিদপুর শহরে মেসে থাকছেন। তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার একটি গ্রামে।

তিনি বলেন, গত তিন-চার মাসের ব্যবধানে মিলচার্জ বেড়েছে অন্তত ১৫ থেকে ২০ টাকা। আগে মিলচার্জ ছিল ২৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা। গত দুই-তিন মাস ধরে এই মিলচার্জ পড়ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এই খরচের ভেতর খাবার খরচ, বুয়া বিল রয়েছে। গত কয়েক মাসে বেড়েছে সয়াবিন তেলের দাম। এছাড়া এমন কোনো খাদ্যদ্রব্য নেই যার দাম বাড়েনি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল মেসের প্রচলিত খাবার ডাল, ব্রয়লার মুরগি এবং ডিম এসবের দামও বেড়েছে। এজন্য খরচ কমানোর দিকে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি বলে ভালো খাবার বা স্পেশাল মিলের কথা ভাবতে পারি না।

শহরের আলীপুরের একটি মেসে ১৪০০ টাকা মাসিক সিট ভাড়া দিয়ে থাকেন ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার নিয়ামতুল্লাহ (২৪)। তিনি শহরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ইতিহাস  বিভাগের স্নাতক ৪র্থ বর্ষের ছাত্র।

তিনি বলেন, ২০১৬ সাল থেকে ফরিদপুর শহরে মেসে থাকি। ছয় বছর আগে শহরের টেপাখোলা মহল্লায় একটা মেসে থাকতাম। টিনের চালের ওই ঘরে একটা কক্ষে দুইজন মিলে ভাড়া দিতাম ৫০০ টাকা। এখন শহরের চরকমলাপুর একটি মেসে থাকি। এখানে আমার একার রুম ভাড়া দিতে হয় ১৭০০ টাকা। যা প্রায় ১৫০০ টাকা বেশি আগের চেয়ে। এখন প্রতিটা জিনিসের মূল্যই এভাবে বেড়েছে কয়েকগুণ করে।

সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের স্নাতক (ডিগ্রি) শ্রেণির ছাত্র রনি হোসাইন (২৩)। তিনি বলেন, মাস ছয়েক আগেও বাড়ি থেকে প্রতি মাসে থাকা খাওয়া খরচ মিলিয়ে সাড়ে চার হাজার টাকায় হয়ে যেত। এখন প্রতি মাসে ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা আনতে হয় বাড়ি থেকে। এখন ১০ টাকা খরচ করলেও হিসেব করে খরচ করতে হয়। আগে মেসের তরকারি ভালো না হলে একটা ডিম ভেজে খেতাম। এখন সয়াবিন তেলের দামের যে অবস্থা, গ্যাসের দাম এসব মিলিয়ে একটা ডিম ভাজলে মেসের অন্য সদস্যরা বিষয়টি মেনে নেয় না।

শহরের চরকমলাপুর মহল্লার একটি মেসের সদস্য সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমন হোসেন (১৯) বলেন, সকালে আলু ভর্তার হাফ মিল, দুপুরে এক টুকরো মাছ আর ডাল এবং রাতে এক টুকরো ব্রয়লার মুরগি খাই। মাছ, মাংসের টুকরাও আগের চার ভাগের একভাগ হইছে। মাঝেমধ্যে দুপুর, রাতে ছোট মাছ ও ডাল জোটে। এই খাবার খেয়ে মাস শেষে হিসেব করে দেখা যায় খরচ সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফরিদপুর ছাড়াও রাজবাড়ী, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরাসহ আশপাশে বিভিন্ন জেলার শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে আসেন ফরিদপুর শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এদের বেশিরভাগই সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী। এছাড়াও জেলা শহরের সরকারি ইয়াছিন কলেজ, সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজ, ফরিদপুর সিটি কলেজ, ফরিদপুর মহাবিদ্যালয়, কৃষি কলেজ ফরিদপুর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর প্রকৌশল কলেজ, ফরিদপুর সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ আরও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্তত অর্ধলাখ শিক্ষার্থী ফরিদপুরে পড়াশুনা করেন। 

তারা শহরের বাইতুল আমান, কমলাপুর, চরকমলাপুর, দক্ষিণ ঝিলটুলী, পূর্ব খাবাসপুর,পশ্চিম খাবাসপুর,আলীপুর, লালেরমোড় বিভিন্ন সেমিপাকা ও পাকা বাড়ি ভাড়া নিয়ে নিজেদের ব্যবস্থাপনায় মেস হিসেবে বসবাস করেন। ফরিদপুরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আবাসিক হলে শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য আসন সংখ্যা খুবই কম বলে বাধ্য হয়েই শিক্ষার্থীদের এসব মেসে থাকতে হয়। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধি, হোটেল রেস্টুরেন্টে কাজ করা কর্মীরা এসব মেসে ভাড়া থাকেন।

জহির হোসেন/আরএআর