১২০০ শিশুকে পৃথিবী দেখিয়েছেন রেজিয়া
ময়না খাতুনের প্রসবব্যথা শুরু হলো। গ্রামে ধাত্রী পাওয়া গেল না। আশপাশের কয়েক গ্রামেও হাসপাতাল নেই। চিন্তায় অস্থির স্বজনেরা। নিরুপায় হয়ে পাশের বাড়ির রেজিয়া আক্তারকে ডাকা হলো। যদিও রেজিয়া ধাত্রী নন। তবে মামির সঙ্গে থেকে জেনেছেন, কীভাবে সন্তান প্রসব করাতে হয়। ওইটুকু জানা-শোনা দিয়েই জীবনে প্রথম ময়না খাতুনের সন্তান প্রসবের কাজে হাত দিলেন রেজিয়া। প্রথমবারেই সফল।
১৯৬২ সালে ময়না খাতুনের সন্তান প্রসবের মধ্য দিয়ে ধাত্রীর দায়িত্ব কাঁধে নেন। আজো বিনামূল্যে ধাত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন রেজিয়া। শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখানোর আগ মুহূর্তে ডাক পড়ে তার। ছুটে যান নিজ গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে।
বিজ্ঞাপন
বিরতিহীন ছুটে চলায় যেন কাজ রেজিয়া আক্তারের। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারসিন্দুর ইউনিয়নের মজিতপুর গ্রামের মৃত কৃষক গিয়াস উদ্দিনের স্ত্রী তিনি। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার টোকনয়ন গ্রামের হাজী মুন্সির ঘরে তার জন্ম। অল্প বয়সে তার বিয়ে হয়ে যায় গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে। এজন্য লেখাপড়া বেশি করতে পারেননি। শুধু নামটুকু লিখতে পারেন।
বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি চলে যান। এক ছেলে পাঁচ মেয়ের জন্ম দেন তিনি। ছেলে রায়হান ও মেয়ে মাজেদা, সাজেদা, রাশেদা, খোশেদা ও ইতিকে নিয়ে সুখেই চলছিল তার সংসার। ২০০৭ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে স্বামী গিয়াস উদ্দিন মারা যান। ২০১৫ সালে একমাত্র ছেলে রায়হানেরও মৃত্যু হয়। স্বামী ও ছেলের মৃত্যুর পর ভেঙে পড়েন রেজিয়া। তবে থেমে ছিল না ধাত্রীর কাজ।
বিজ্ঞাপন
রেজিয়া আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাত-আট বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়ে যায়; তাই পড়ালেখা করতে পারিনি। সন্তান লালন-পালন ও স্বামীর সংসারে কাজ করেছি। প্রতিবেশীদের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছি। সবসময় তাদের উপকার করেছি।
ধাত্রীর কাজ কখন কীভাবে শুরু করেছেন জানতে চাইলে রেজিয়া আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৬১-৬২ (১৯৬১-৬২) সাল হবে। তখন আমি স্বামীর বাড়ি। প্রতিবেশী ময়না খাতুনের প্রসবব্যথা শুরু হলে আমাকে ডাকা হয়। আমার মামি ধাত্রী ছিলেন। ধাত্রীর কাজে তাকে কয়েকবার সহায়তা করেছি। তাকে সহায়তা করতে গিয়ে জেনেছি, কীভাবে সন্তান প্রসব করাতে হয়। তবে ধাত্রীর কাজে প্রশিক্ষণ কিংবা প্রতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা আমার নেই। হাতেকলমে মামির সঙ্গে থেকে যা শিখেছি, তা দিয়ে ধাত্রীর কাজ শুরু করি।
বিনামূল্যে ধাত্রীর কাজ শুরু করেছি; এখনো করছি। যতদিন শরীর কুলায় ততদিন এই মহান কাজটি করে যাব। আমার হাতে এ পর্যন্ত ১২শ’র অধিক শিশুর জন্ম হয়েছে। এদের অনেকের ছেলে-মেয়েরও আমার হাত ধরে জন্ম হয়েছে। এর মধ্যে একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন।
রেজিয়া আক্তার, ধাত্রী
রেজিয়া আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো নারীর প্রসবব্যথা উঠলে যখন আমাকে ডাকা হয়, দেখেই বুঝতে পারি, সন্তান নরমালে হবে নাকি হাসপাতালে নিতে হবে। যদি দেখি নরমালে হবে না; তখন হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দিই। কোনোদিন চাইনি কারও সন্তানের ক্ষতি হোক কিংবা দুর্ঘটনা ঘটুক।
তিনি বলেন, এখন মোবাইলের যুগ। আগে থেকেই প্রসূতির পরিবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন; যাতে সঠিক সময়ে তাদের বাড়িতে উপস্থিত থাকি। আমিও আগে যাওয়ার চেষ্টা করি। এ কাজের জন্য আজ পর্যন্ত কারও কাছ থেকে টাকা-পয়সা দাবি করিনি। তবে অনেকেই খুশি হয়ে আমাকে উপহার দিয়েছেন। এই মহান কাজের জন্য আমি কারও কাছে কিছু চাই না। আমার সংসারে উপার্জনক্ষম কেউ নেই। পরিবার ও মেয়েদের সহায়তায় সংসার চলে। জীবনের শেষ সময়টুকু যেন ভালোভাবে চলতে পারি সেজন্য সবার দোয়া চাই সহযোগিতা চাই।
মজিতপুর গ্রামের বাসিন্দা ফাতেমা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, রেজিয়া খালার হাতে আমার তিন সন্তানের জন্ম হয়েছে। সন্তান প্রসবের সময় হলে গ্রামের সবাই তাকে ডাকেন। এ কাজের জন্য কোনোদিন কারও কাছে টাকা-পয়সা নেননি। আমরা খুশি হয়ে যা দিই তাতেই তিনি সন্তুষ্ট।
মজিতপুর মহিলা মাদরাসার শিক্ষক হাফেজ মাওলানা মো. শামসুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ প্রবাদের বাস্তব উদাহরণ রেজিয়া আক্তার। বছরের পর বছর ধাত্রীর কাজ করে মানবিকতার নজির গড়েছেন। যে কাজ করার কথা চিকিৎসক ও নার্সের; তা বিনামূল্যে করছেন রেজিয়া। আল্লাহ তাকে অনেক বছর বাঁচিয়ে রাখুক।
এগারসিন্দুর ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) মো. আলতাব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, যদি রেজিয়া আক্তারের কোনো সহায়তার প্রয়োজন হয়; চেয়ারম্যানের মাধ্যমে ব্যবস্থা করে দেব। রেজিয়া আক্তার অনেক ভালো ধাত্রী। বিভিন্ন গ্রামে তার অনেক সুনাম রয়েছে।
কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মো. মুজিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাঝেমধ্যে সরকারিভাবে ধাত্রী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। যদি রেজিয়া আক্তার প্রশিক্ষণ নিতে চান; তাহলে সহায়তা করা হবে।
তিনি বলেন, গ্রামাঞ্চলের ৯০ শতাংশ নারীর প্রসব হয় ধাত্রীর সহায়তায়। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় আমাদের অন্যতম সাফল্য হলো; শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা। এ লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
মাতৃত্বকালীন মৃত্যুর হার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনুন্নত দেশগুলোতে অনেক বেশি। বিশ্লেষকরা জানান, বাংলাদেশে এক-চতুর্থাংশ নারী মা হওয়ার সময় প্রয়োজনীয় সেবা এবং সুযোগ-সুবিধা পান।
সরকারি সর্বশেষ হিসাব মতে, প্রতি বছর ১ লাখ শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১৭০ মা মারা যান। তবে প্রকৃত পক্ষে সামগ্রিকভাবে, বছরে কয়েক হাজার মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। অদক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে ডেলিভারি আর প্রয়োজনীয় সেবা না পাওয়ায় হাজার হাজার মা সারাজীবন বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভোগেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রত্যেক দিন সারা বিশ্বে ১ হাজার ৬০০ এবং প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ ৮৫ হাজার নারী গর্ভধারণ এবং পরবর্তী বিভিন্ন জটিলতায় মৃত্যুবরণ করেন।
নারী স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষকরা বলছেন, গ্রামাঞ্চলে সন্তান প্রসবের সময় দক্ষ প্রসব সহায়তাকারী বা ধাত্রীর উপস্থিত নিশ্চিত করা গেলে মাতৃমৃত্যু কমে আসবে। একটি বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী আমাদের দেশে বছরে প্রায় ৪০ লাখ মা গর্ভধারণ করেন। এর মধ্যে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতায় প্রতি হাজারে মারা যান পাঁচজন। বাংলাদেশে মৃত্যুর এ হার ভিয়েতনাম এবং মালয়েশিয়ার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। প্রসূতিজনিত জটিলতায় মৃত্যুর পাশাপাশি অচেতনতার কারণে হাজারে আরও ৫০ মহিলা বিভিন্ন রোগাক্রান্ত হয়ে বেঁচে থাকেন।
এএম