লাকী বেগম

জন্মের আগেই হারিয়েছেন বাবা। মা মারা গেছেন জন্ম দেওয়ার পরেই। এরপর সাত বছর বয়সে চাচার হাত ধরে সিলেটে আসেন তিনি। বিয়ে হয়েছিল ২২ বছর বয়সে। তার ঠিক দুই বছর পর স্বামীও ছেড়ে পালিয়ে যান। এখন তার বয়স ৪৫। দীর্ঘ ২৭ বছর থেকেই চা বিক্রি করেই পরিবারের সব খরচ চালাচ্ছেন তিনি।

সিলেট নগরের কিন ব্রিজের নিচেই দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে চা বিক্রি করে আসছেন লাকি। হবিগঞ্জ জেলার বানিংয়াচং উপজেলার নন্দিপাড়ায় জন্ম হলেও ১৯৮৩ সালের পর থেকে সিলেট নগরের মির্জাজাঙ্গাল এলাকায় ভাড়া বাড়িতে আছেন তিনি।

রাস্তার পাশে একটি টং দোকান। তার পাশেই খালি জায়গায় একটি বেঞ্চ ও দুটি চেয়ার। আর এখানে যারা আসছেন চা পান করতে, তাদের নিজ হাতে চা বানিয়ে দেন। জীবনের নানা চড়াই-উতরাই নিয়ে লাকী বেগমের কথা হয় ঢাকা পোস্টের সঙ্গে।

লাকি বেগম বলেন, আমি খুব কষ্ট করেছি। কষ্ট করতে করতে এই অবস্থায় এসেছি। সিলেটের একজন ভালো মানুষের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল। প্রথম সন্তান হওয়ার পরই স্বামী আমার টং দোকান বিক্রি করে পালিয়ে যায়। এরপরে ভাড়া একটি ভ্যানগাড়ি নিয়ে ব্যবসা করে আসছি। প্রতিদিন ৫০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। দোকানটাও ভেঙে গেছে, বৃষ্টি এলে ভিজে ব্যবসা করতে হয়। কোনো দিন ব্যবসা করা যায়, কোনো দিন করা যায় না।

আমি নিজে উপার্জন করি। একদিকে যেমন ভালো লাগা কাজ করে, অন্যদিকে নিজের কাছে খুব খারাপ লাগে। আমি একজন নারী হয়ে চা বিক্রির কাজটি করছি। আমার সব থেকে খারাপ লাগার জায়গা আমার দুই সন্তান। এদের জীবনকে কতটুকু সুন্দরভাবে সাজাতে পারব, এটা নিয়েই আমি চিন্তিত থাকি সব সময়। এখন তো কোনো রকমে আমার সন্তানদের নিয়ে দিন চলে যাচ্ছে। রাতে আমার ঘুম আসে না আমার সন্তানদের জন্য আমি কী করতে পেরেছি।

দালালের প্ররোচনায় বছর দুয়েক আগে বিদেশে পাড়ি জমান লাকি বেগম। নিজের ভাগ্যবদলের আশায় ধারদেনা করে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দালালের হাতে সোপর্দ করে সৌদি আরবের জেদ্দার উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। সেখানে পৌঁছার পর তার জীবনে নেমে আসে করুণ পরিণতি। ১৮ দিনের নির্যাতন সহ্য করে পালিয়ে গিয়ে সেখানকার দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশে ফিরে আসেন তিনি।

লাকি বেগম বলেন, আমি বিদেশে গিয়ে ৫০ হাজার টাকা রোজগার করে নিজের ভাগ্য বদল করতে পারব। এমন একটা লোভ দেখিয়েছিল দালাল। আমিও আমার সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে ধারদেনা করে টাকা জমিয়ে বিদেশ যাই। তবে সেখানে গিয়ে দেখি অন্য রকম চিত্র। সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়ে দূতাবাসের সাহায্যে আমি দেশে ফেরত আসি। এরপর থেকে আবার সেই টং দোকানে আমি ব্যবসা শুরু করি।

লাকি জানিয়েছেন, বিদেশে যাওয়ার জন্য যে দালালকে টাকা দিয়েছিলেন, তা উদ্ধারের জন্য থানায় মামলা করতে যান। তবে থানার তৎকালীন পুলিশের উপপরিদর্শক মামলা না নিয়ে আপসে যাওয়ার কথা জানান। তবে সেটি না করে তিনি আদালতে মামলা করেন। সেখানে থেকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মামলার তদন্তভার পেলে সেখানে আড়াই লাখ টাকার সত্যতা পান। পরবর্তীতে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে আড়াই লাখের বিষয়ে জানালে তিনি কিছু বলেননি। কারণ তার পক্ষে কোনো উকিল ছিলেন না। এখন মামলাটি আদালতে পড়ে থাকলেও টাকার অভাবে তিনি সেটি চালাতে পারছেন না।

তিনি বলেন, আমার মতো দালালের খপ্পরে পড়ে কোনো নারী যাতে বিদেশে না যান। কারণ, ১৮ দিনে যা দেখেছি, উপলব্ধি করেছি, সেখানকার চিত্র ভয়াবহ। বাঙালি নারীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি নানাভাবে প্রতারিত করা হচ্ছে। কেউ সহ্য করে সেখানে পড়ে আছে, আবার কেউ পালিয়ে এসে দূতাবাসের সাহায্যে দেশে ফেরত আসছে।

সড়কের পাশে ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতার বেশির ভাগ সময় ভোগান্তি পোহাতে হয় ব্যবসায়ীদের। বিশেষ করে সড়কের পাশে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের জন্য বর্তমানে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সিলেট সিটি করপোরেশন। প্রায়ই অভিযানে নেমে তাদের এসব স্থান থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এতে তারা খুব বেশি বিপাকে পড়েন। লাকি আক্তারও তেমন বিপদে পড়েন।

লাকি আক্তার বলেন, আমার বয়স এখন প্রায় ৪৫। কয়দিনই বা বাঁচব। এখন কোনোমতে সংসার চালাচ্ছি। ছেলে-মেয়েদের জন্য কিছুই করে যেতে পারছি না। সরকারের কাছে আমার আবেদন আমি যাতে সন্তানাদি নিয়ে শেষ বয়সে এসে কোনোমতে সংসার চালাতে পারি, দুবেলা খেয়েপরে বাঁচতে পারি, সেই ব্যবস্থা করে দেন। বিদেশে গিয়ে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছি।

এনএ