চা-পাতা তোলায় ব্যস্ত নারী চা-শ্রমিকরা

২০ বছর আগে স্বামীকে হারান চা-শ্রমিক ময়না রাজভার। এরপর শুরু হয় তার জীবনসংগ্রাম। ছোট ছেলেকে গর্ভে রেখেই মৃত্যুবরণ করেন স্বামী রামরুবি রাজভার। ২০০২ সালে তখন মেজ ছেলে সঞ্জিতের বয়স পাঁচ আর বড় ছেলের রঞ্জিতের বয়স ছিল সাত বছর। এখন ৬৫ বছর বয়সে এসেও পরিবারের বোঝা ব‌ইতে হচ্ছে তাকে।

পরিবারের অভাবের কারণে কোনো ছেলেকেই পড়ালেখা করাতে পারেননি। ৪০ বছর ধরে চা-বাগানে পাতা তোলার কাজ করেন ময়না। তখন বাগানে হাজিরা পেতেন মাত্র ৩২ টাকা। এই একটা হাজিরা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ত।

এখন ছেলেরা বড় হয়েছে। দুই ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছে। কদিন পরেই বিয়ে। এক লাখ টাকা লোন নিয়েছেন একটি বেসরকারি সমিতি থেকে। ছেলেরা এখনো কোথাও কোনো কাজ পাননি। বস্তিতে ছোটা কাজ করে কোনো রকম সংসার চলে। এখন জীবনের শেষ সময়ে এসেও ঋণের বোঝা মাথায় চেপেছে। সেই কথা ভাবতেই তার জীবনটা অন্ধকার মনে হয়।

মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার মাথিউরা চা-বাগানের ৮ নম্বর সেকশনে ময়না রাজভারের ঘর। সেই ৪০ বছর আগের ভিটাতেই একটি মাটির কুঁড়েঘরে তিন ছেলেকে নিয়ে থাকেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমার স্বামী মারা যাওয়ার ১৯ বছর চলে গেছে। খুব গরিব অবস্থায় আমাদের অসহায় করে তিনি চলে গেলেন। আমার বাচ্চাদের আমি মানুষ করলাম। কিন্তু অপসোস রয়ে গেল। লেখাপড়া করাতে পারিনি। এখন দুই ছেলেকে বিয়া করাতে হবে। এখন গরিব অবস্থায় দুই ছেলের বিয়া কীভাবে করাব, সেই চিন্তায় আছি।

বাগানে কুঁড়ি তুলছেন চা-শ্রমিক নারীরা

ময়না রাজভার বলেন, একটা রুজির মাঝে তারারে খাওয়াব না পড়াব? কিছু তো করতে পারলাম না। একটা হাজিরা নিয়া তাদের নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছি। এক বেলা খাইলে এক বেলা পাই না। এক বেলা খাইলে আরেক বেলা বাচ্চাকাচ্চারে নিয়া উপাস থাকি। সকালে যদি খাই তাইলে বিকালে উপাস থাকি। বিকালে খাইলে রাতে তারারে নিয়া উপাস ঘুমাই থাকি। ওই সময় কেউ সাহায্য করেনি। এখনো করেনি, তখনো করেনি। বাগানের পঞ্চায়েতের কাউরে পাইনি।

কল্যাণ তহবিলের কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের বাগানের মানুষ কেউ আমারে দুই টাকা হোক পাঁচ টাকা হোক কেউ দেয়নি। কেউ কোনো দিন দেখেওনি। পরিবারে আমি একা রুজি করি। ছেলেদের কোনো রুজি নেই। বস্তিতে টুকিটাকি কাজ করে।

ময়না রাজভারের মতো রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে নারী চা-শ্রমিকদের জীবনের ৩০ থেকে ৩৫টি বছর কেটে যায়। দাঁড়িয়ে চা-বাগানের টিলায় টিলায় পাতা তুলেই নিঃশেষ হয় তাদের স্বপ্ন। সবুজ চা-বাগানের ছবি যতটা সৌন্দর্যময়, ঠিক ততটাই বেদনাদায়ক এক একজন নারী চা-শ্রমিকের জীবনের গল্প। সারা দেশে ১৬৭টি চা-বাগান আছে। এর মধ্যে দেশের সিংহভাগ চা-বাগানগুলো মৌলভীবাজার জেলায়।

পানি আনতে যাচ্ছেন নারী চা-শ্রমিকরা

এসব বাগানে প্রায় এক লাখ চা-শ্রমিক কাজ করছেন। এই শ্রমিকদের মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি। পাতা বা কুঁড়ি তোলার প্রধান কাজটিই করেন নারী চা-শ্রমিকেরাই। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নারী শ্রমিকেরা এই কাজ করে গেলেও কাজের ক্ষেত্রে যে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা, তার অনেক কিছুই এখনো নাগালে আসেনি।

চা-বাগানের নারী শ্রমিকরা জানান, বাগানে সকাল ৯টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। সংসারের কাজ করতে উঠতে হয় সাতসকালে। সপ্তাহে সোম থেকে শনিবার নিয়মিত বাগান খোলা থাকে। কেউ সকালে খেয়ে বের হন, কারও সময় না থাকলে বাটিতে খাবার নিয়েই ছুটতে হয়। বাড়িতে ফিরতে ফিরতে কারও সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত আটটা বেজে যায়। ঘরে ফিরে আবার সংসারের কাজ।

এভাবেই চলে তাদের দিন। চা-বাগানে বর্তমানে দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা। এ মজুরি পেতে বাগানভেদে ২০ থেকে ২৫ কেজি চাপাতা তুলতে হয় নারী শ্রমিককে। বাড়তি চা-পাতা তুললে যে পরিমাণ টাকা পাওয়ার কথা, তাও পান না বেশির ভাগ নারী শ্রমিক। এ ছাড়া যাতায়াতের গাড়ি না থাকা, বিশুদ্ধ পানি না থাকার অভিযোগ করেন শ্রমিকরা।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শৈত্য নাইডু ঢাকা পোস্টকে বলেন, এত বড় চা-শিল্পকে টিকিয়ে রাখছেন নারীরা। তা সত্ত্বেও চা-বাগানের নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত। তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কাজের পরিবেশ উন্নত করতে হবে। নারী শ্রমিকদের হয়রানি ও তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ করতে হবে।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলছেন ময়না

তিনি বলেন, ময়না রাজভারের মতো অনেক নারী শ্রমিক এভাবে কষ্টে দিন পার করেন। কেউ তাদের দেখে না। আর সরকারি তহবিলের অর্থ পঞ্চায়েত কমিটির আস্থাভাজনদের মধ্যে চলে যায়। চা-শিল্পের অগ্রগতি ঘটাতে হলে নারী চা-শ্রমিকের প্রতি সুদৃষ্টি দিতে হবে।

বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, চা-বাগানে অর্ধেক নারী শ্রমিক হলেও নারী হিসেবে কর্মস্থলে যে সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার, তা তারা পাচ্ছেন না। বিশেষ করে চা-পাতা উত্তোলনের পর যে সঠিক মজুরি পাওয়ার কথা, সেটা থেকে তারা আজও বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার নারী শ্রমিকরা প্রশাসনিক কাজে কম নিয়োগ পান, সেটিকেও বাড়াতে হবে।

তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা নারী শ্রমিকদের অধিকাংশ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্য নারীদের জন্য বিশেষায়িত কলেজ, স্কুল ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে হবে। অথচ চা-বাগানে নারীরা উপার্জন করলেও অনেক ক্ষেত্রেই তারা পিছিয়ে রয়েছেন।

চা-বাগানের মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশ চা-সংসদের সিলেট অঞ্চলের চেয়ারম্যান জি এম শিবলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, শ্রমিকেরা মজুরি ১২০ টাকা পান। শ্রমিকদের ইউনিয়নের সঙ্গে দুই বছর পরপর মালিকপক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সবকিছু ঠিক করা হয়। চা-বাগানে সব শ্রমিক বিনা মূল্যে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়। হাসপাতাল আছে। সবকিছু মিলিয়ে তারা ভালো আছেন।

এনএ