‘আমি তো ইপিজেডে চাকরির ডিউটিতে গেছিলাম, ওইখানেই শুনি যে আমার সন্তানরা ট্রেনে এক্সিডেন্ট হইছে। বাড়ি আসি শুনি তারা ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেইছে। পরে কি হইছে আর কিছু বলতে পারি না। আইজ এক বছর হলো আমার বুকের ধনগুলা নাই। তাদের কথা মনে পড়লে এখনোও বুক ফেটে যায়। আমার ৪০ দিন আগে একটা ছেলে সন্তান আল্লাহ দিছে তবুও তাদের হারানোর কষ্টটা আজও ভোলা সম্ভব নয়। এ ব্যাথা সারাজীবন থাকবে।’

কথাগুলো কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ প্রতিবেদককে বলছিলেন নীলফামারীর সদরের কুন্দপুকুর মনসাপাড়া বউবাজার এলাকায় ট্রেন দুর্ঘটনায় একসঙ্গে নিহত তিন শিশুর মা মজিদা বেগম। 

গত বছরের ৮ ডিসেম্বর সকাল আটটার দিকে বউবাজার এলাকায় চিলাহাটি থেকে খুলনাগামী খুলনা মেইল ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান তার বড় মেয়ে রিমা আক্তার (৮), মেজ মেয়ে রেশমা (৪) ও ছোট ছেলে মমিনুর রহমান (৩)। এসব শিশুদের বাঁচাতে গিয়ে সালমান ফারাসি শামিম হোসেন (৩০) নামে একজন নিহত হয়েছিলেন। তিনি মনসাপাড়ার মৃত আনোয়ার হোসেনের ছেলে।

সালমান ফারসি শামীম হোসেনে স্ত্রী ও সন্তান

 

সন্তানদের হারানোর এক বছর হলেও আজও তাদের কথা ভেবে চোখের পানি ঝরে মজিদা বেগমের। তাদের কষ্ট ভুলতে চতুর্থ সন্তান নিয়েছেন তিনি। ভেবেছিলেন এই সন্তান বুকে নিয়ে ভুলবেন তাদের হারানোর কষ্ট। কিন্তু সেই কষ্ট যেন কোনোভাবেই ভোলার নয়।

সন্তানদের হারিয়ে ইপিজেডের চাকরি ছেড়েছেন মজিদা। রিকশা চালিয়ে স্বামী রেজওয়ানের যা আয় হয় তা দিয়ে কোনোমতে চলছে তাদের সংসার। দুর্ঘটনার পর মজিদার স্বামী রেজওয়ানকে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন রেলপথ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন। আর রেজওয়ানের পরিবারের পাশে থাকার কথা জানিয়েছিলেন নীলফামারী-২ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তবে এক বছরেরও শেষ হয়নি সেই আশ্বাসের প্রহর।

মা মজিদা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রেলমন্ত্রী কইছিলো চাকরি দিবে, কিন্তু কাগজপত্র একবার নিয়া আর খোঁজ নাই। নুর এমপি কইছিলো পাশে থাকবে, তিনি আর কোনো খোঁজই নেই নাই আমাদের। এমন কী সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধাও দেয় না আমাদের। সবাই সরকারি কত অনুদান পায়, অথচ আমরা কিছুই পাই না।

নিহত শিশুদের নানি মোর্শেদা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাচ্চাগুলো আমাদের বাড়িতে ছোট থেকে বড় হইছে। কষ্টটা আমাদের আরও বেশি। ওর নানা তো হার্টঅ্যাটাক করছিলো। এতো কষ্টের পর কাহো একনা সহযোগিতা করলো না। ঘরটা ভাঙি গেছিলো, জামাই লোন নিয়া ঠিক করছে। তাও কাহো সাহায্য করে নাই।

স্থানীয় বাসিন্দা জয়নাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাচ্চাগুলো চোখের সামনেই খেলাখেলে বেড়াইছিলো। সেদিন যে এমন হবে ভাববার পাইনাই। সেদিন খুব কুয়াশা ছিল আর ট্রেনটাও একনাও বাঁশি বাজায় নাই। আর ফির ইটের ট্রলির শব্দে কেউ বুঝে নাই যে ট্রেন আসি গেইছে। তিনটা বাচ্চা চলি যাওয়ার পরও বাপ-মাও যে বাঁচি আছে এটাই ভাগ্য।

এদিকে সালমান ফারসি শামীম হোসেনের স্মৃতি আর একমাত্র মেয়ে মেফতাহুল জান্নাতকে বুকে আগলে বেঁচে আছেন সুমাইয়া আক্তার সুমী। এক বছর আগে ছেলের অকালমৃত্যুতে মা চিনু বেওয়ার চোখের পানি এখনো ঝড়ছে। আয় রোজগারের একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে তিন সদস্যের পরিবারটির এখন দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে। জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছে সুমির পরিবার।

ঘটনাটির পর, গত বছরের ১১ ডিসেম্বর নিহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। ওইদিন ব্যক্তিগত তহবিল থেকে নিহত তিন শিশুর বাবা রিকশাচালক রেজওয়ান হোসেনকে ৫০ হাজার টাকা সহায়তা দেন। এছাড়া নিহত সালমান ফারাসি শামীম হোসেনের স্ত্রী সুমির হাতেও ২০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন সহায়তা হিসেবে। পরে বউবাজারে নিহতদের স্মরণসভায় তিন শিশুর বাবা রেজওয়ান হোসেন ও নিহত সাহসী যুবক শামীম হোসেনের স্ত্রী সুমাইয়া আক্তারকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

এরপর মন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে আশার আলো দেখেন সুমী। গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকায় রেলের ‘পয়েন্টস ম্যান' পদের জন্য পরীক্ষায় বসেন। ফল প্রকাশ হলে জানতে পারেন তিনি উত্তীর্ণ হননি। স্বপ্ন দেখা চোখে ঘনিয়ে আসে ঘোর অন্ধকার।

শামীমের স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার সুমী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আত্মীয়-স্বজনদের সাহায্যে এই একটি বছর কোনোরকমে কেটে গেলো। এভাবে আর কতদিন চলবে। মেয়েকে এবার স্কুলে ভর্তি করাবো। মেয়েকে বোঝাতে পারছি না যে, তার বাবা আর নেই। সে জানে ঢাকায় তার বাবা চাকরি করছে। এদিকে চাকরির আশায় আশায় বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরছি।

তিনি বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর দেড় মাস আগে আমাদের খোঁজখবর নিয়েছেন। তিনি আমার সিভি নিয়েছেন। এখন শুধু আশায় বসে আছি। আজকেও ডেকেছিল, আমি আমার শাশুড়িসহ গেছিলাম তিনি আবারও আশ্বাস দিয়েছেন চাকরি হবে এবং প্রতিমাসে আর্থিক সহায়তা করবেন বলে জানিয়েছেন।

শামীমের মা চিনু বেওয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১১ বছর আগে শামীমের বাবা সৌদি আরবে চাকরিরত অবস্থায় মারা যায়। সেই থেকে শামীম সংসার দেখাশোনা করতো। ছেলেকে হারিয়ে আমরা এখন অসহায়। পুত্রবধূ সুমীর একটা কর্মসংস্থান হলে এ অসহায়ত্ব থেকে রেহাই পাবো।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ৮ ডিসেম্বর সকালে রেললাইনের ওপর খেলছিল তিন শিশু। ঘন কুয়াশার কারণে বেশি দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল না। একটা ইটবাহী ট্রলির শব্দের কারণে ট্রেনের শব্দও বোঝা যায়নি। হঠাৎ করেই ট্রেন আসতে দেখে সেতু সংস্কারকাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পাহারাদার সালমান ফারসি জীবনের ঝুঁকি জেনেও বাচ্চাদের রক্ষা করতে যান। একটি শিশুকে কোলে নিয়ে রেললাইন থেকে লাফ দেওয়ার আগেই ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়েন। শিশু তিনটির সঙ্গে তিনিও ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান।

এমএএস