বাঙালির আধুনিক যুগের ইতিহাসে যে নারীর নাম গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়, তিনি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বাঙালি সমাজ যখন ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল, সেই সময় রোকেয়া সাখাওয়াত বাংলার মুসলিম নারী সমাজে শিক্ষার আলো নিয়ে এসেছিলেন। বাঙালি মুসলমান নারী জাগরণের তিনি ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ। আজ এই মহিয়সী নারীর ১৪২তম জন্মবার্ষিকী এবং ৯০তম প্রয়াণ দিবস।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে আলোকবর্তিকা হয়ে আছেন। অথচ বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে সেই রোকেয়ার জীবনগল্প বিভিন্ন ভুল তথ্যে ভরা। বেগম প্রথার বিরুদ্ধে তিনি লড়েছেন, সেই বেগম শব্দটিও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তার নামের সঙ্গে ভুলভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যার দায় বাংলা একাডেমিও নিতে চায় না। এদিকে এমন ভুল তথ্যে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ রোকেয়া গবেষকরা।

সম্প্রতি রোকেয়া দিবসের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীবন নিয়ে লেখা সপ্তম শ্রেণির সপ্তবর্ণা পাঠ্যবইয়ে ভুল ধরা পড়েছে। এই ভুল দিয়েই শেষ হতে চলছে চলতি শিক্ষাবর্ষ। আর এই বই পড়ে দেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থী ভুল এবং বিকৃত ইতিহাস শিখছে। এ নিয়ে কারো কোনো গরজ নেই। যা দেখে ক্ষুব্ধ পায়রাবন্দের রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল।

এই সংগঠকের অভিযোগ, পাঠ্যপুস্তকে নতুন প্রজন্মকে রোকেয়া সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা এসব ভুল সংশোধনে সরকার সংশ্লিষ্ট কেউই ভ্রুক্ষেপ করছেন না। বরং সরকারি পৃষ্টপোষকতায় কোথাও কোথাও বড় ধরনের তথ্য বিভ্রাটে রোকেয়া সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম ভুলের মধ্যেই বেড়ে উঠছে।

বহু বছর ধরে রোকেয়ার চিন্তা-চেতনার সমাজ বিনির্মাণের আন্দোলনে সম্পৃক্ত রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, সরকারি পৃষ্টপোষকতায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপ্রস্তুক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য সপ্তবর্ণা নামে ২০১৯ সালে প্রকাশিত বাংলা বইটির ৪৫ নম্বর পৃষ্ঠায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন শিরোনামে সেলিনা হোসেনের একটি লেখা রয়েছে। যেখানে বাংলা একাডেমির সভাপতি কথা সাহিত্যক সেলিনা হোসেন লেখাটির প্রথম লাইনে বলেছেন, সাড়ে তিন বিঘা জমির মাঝখানে রোকেয়ার বাড়ি ছিল। রোকেয়ার বিয়ে ১৮৯৮ সালে হয়েছে। ১৯১৫ সালে আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম নামে একটি মহিলা সংগঠন রোকেয়া প্রতিষ্ঠা করেন। ওই একই লেখক আবার ২০২২ সালে প্রকাশিত সপ্তম শ্রেণির সপ্তবর্ণাতেই রোকেয়ার বিয়ে ১৮৯৭ হয়েছে এবং আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম সংগঠনটি ১৯১৬ সাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে সংশোধন করলেন। এখন আমাদের প্রজন্ম যারা ২০১৯ সালে রোকেয়া সম্পর্কে জেনেছেন, তাদের জানার সঙ্গে ২০২২ সালের শিক্ষার্থীদের জানা তো মিলবে না। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা কোন তথ্যটাকে সঠিক ধরে নেবে?

রফিকুল ইসলামের দাবি, সেলিনা হোসেনের লেখার মধ্যে ভুল তথ্য রয়েছে। এটি সঠিক নয়। তিনি ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে বলেন, বাংলাদেশে রোকেয়াকে নিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুল আলম গবেষণা করে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে তিনি রোকেয়ার বড় বোন করিমন নেছার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন ১৮৯৬ সালের ৩১ মে রোকেয়ার বিয়ে হয়েছে। ওই বিয়েতে করিমন নেছা তার ছোট বোন রোকেয়াকে উপহার স্বরুপ একটি আলোকচিত্র দেন। আমরা মনে করি রোকেয়ার বড় বোনের দেওয়া তথ্যটিই রোকেয়ার বিয়ের সবচেয়ে বড় তথ্য এবং এটি সঠিক।

তিনি আরও বলেন, এখন প্রশ্ন উঠতে পারে রোকেয়া সঠিক না সেলিনা হোসেন সঠিক। সেলিনা হোসেন আমার মনে হয় কোমলমতি বাচ্চাদের ভুল তথ্য দিচ্ছে। ভুল তথ্য নিয়ে আমাদের বাচ্চারা বড় হচ্ছে। রোকেয়ার নিজের লেখা বইয়ের তথ্য দিয়ে বাংলা একাডেমি রোকেয়া রচনাবলী নামে একটি বই প্রকাশ করেছেন। সেখানে ১৪৫ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় লাইনে রোকেয়ার উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে, সেখানে ১৪৫ পৃষ্ঠার (মতিচূর দ্বিতীয় খণ্ড) দ্বিতীয় লাইনে রয়েছে সাড়ে তিনশ বিঘা লা-খেরাজ জমির মাঝখানে রোকেয়ার সুবৃহৎ বাড়ি ছিল। এখন সপ্তবর্ণা বইয়ে সেলিনা হোসেনের লেখা পড়ে রোকেয়ার সম্পত্তি এবং বিয়ের তারিখ সম্পর্কিত তথ্য নিয়ে যে কেউ বিব্রত হতে পারেন। এ কারণে আমি মনে করি সঠিক তথ্য পরিবেশনে সরকারের নজরদারি বাড়ানো উচিত।

শুধু রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সম্পত্তি, বিয়ের তারিখ নিয়েই তার আপত্তি নয়, রোকেয়ার নামে আগে বেগম শব্দের ব্যবহার নিয়ে ঘোর বিরোধিতা রয়েছে রফিকুল ইসলাম দুলালের। এই সংগঠক বলেন, রোকেয়ার সৈয়দ এবং বেগম পদবীর বিপক্ষে অবস্থান ছিল সবসময়। উনি তার স্বামীর নামে প্রতিষ্ঠিত স্কুলেও সৈয়দ নামটি ব্যবহার করেননি। উনি যত চিঠিপত্র, বই লিখেছেন সেখানেও কিন্তু উনি বেগম শব্দটা ব্যবহার করেননি। মিসেস আরএস হোসেন, কোথাও লিখেছেন রোকেয়া খাতুন, কোথাও রোকেয়া এসব লিখেছেন। রোকেয়া তার ভাইকে যখন বই উৎসর্গ করেছেন, সেখানে লিখেছেন স্নেহের রুকু। রোকেয়া কোথাও বেগম শব্দটা ব্যবহার করেননি।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, বেগম শব্দটা রোকেয়ার নামের আগে প্রথম ব্যবহার হয় ১৯৩৬ সালে। সামছুর নাহার মাহামুদ যখন রোকেয়ার জীবনী লিখেন, তখন থেকেই বেগম শব্দটির ব্যবহার। কিন্তু তার আগে আব্দুল রহমান নামে এক ভদ্রলোক রোকেয়ার জীবনী লিখছিলেন। উনি জ্যোতিময় রোকেয়া নামে লেখা বইয়ের কোথাও কিন্তু বেগম শব্দটা ব্যবহার করেননি। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ, সেখানেও রোকেয়ার সঙ্গে বেগম লেখা হয়েছে। নামের ইংরেজি বানানটাও ভুল লিখেছে তারা। অথচ আমরা কিন্তু খ্যাতিমানদের নামের বানান ভুল করি না। আমরা শুধু রোকেয়ার নামের বেলায় ভুল করি। এটা হচ্ছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির দৈন্যতা বলতে পারি। 

গোটা দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীসহ সুশীল সমাজের কাছে আমার অনুরোধ, এক সময়ে রোকেয়া আমাদের সমাজটাকে উদ্ধার করেছেন। আজ যে তাকে নিয়ে বিকৃত ইতিহাস রচিত হচ্ছে, সেখান থেকে আসুন আমরা রোকেয়াকে উদ্ধার করি। এই দায়িত্বটা আজ আমাদের কাঁধে এসেছে। তা না হলে রোকেয়ার সর্ম্পকে আগামী প্রজন্ম একট ভুল তথ্য জানবে। আমাদের সমাজ বিনির্মাণে একটা বড় সংকট দেখা দেবে।
 
দীর্ঘ দিন ধরে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে লেখালেখি করছেন উন্নয়নকর্মী ও সাংবাদিক সরকার মাজহারুল মান্নান। এই সংগঠক বলেন, যখন কারো জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী আসবে, আমরা সেটা পালন করি। এটা আমাদের একটা ট্রাডিশনে পরিণত হয়েছে। এর একটা ইতিবাচক দিকও আছে। কিন্তু সেই দিনগুলোতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে। যদি রোকেয়ার জন্ম-মৃত্যু দিবসে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো যেত, তাহলে আমরা বা আমাদের আগামী প্রজন্ম রোকেয়া সম্পর্কে অনেক বেশি জানতে পারত।

তিনি আরও বলেন, রোকেয়া সাখাওয়াতের কর্ম এবং জীবন অনেক সমৃদ্ধ। তাকে নিয়ে আজ গবেষণা হচ্ছে, পিএইচডি করা হচ্ছে। দেশ-বিদেশে তাকে নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। আমাদের প্রজন্ম কিন্তু রোকেয়া সম্পর্কে সেভাবে জানতে পারছে না। কারণ পাঠ্যপুস্তকে তাকে নিয়ে যে ধরনের তথ্য দেওয়া আছে, সেই তথ্যগুলো সার্বজনীন নয় এবং সেখানে ভুল আছে। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে রোকেয়ার কর্ম এবং জীবনকে উপস্থাপনে খুব জরুরি ভিত্তিতে পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো দরকার। তানাহলে আমাদের আগামী প্রজন্ম রোকেয়া সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে পারবে না। সমতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক মুক্তি ও নারী-পুরুষের মেলবন্ধনে রোকেয়ার যে দোতনা ছিল, সেটি কিন্তু প্রজন্ম উপলব্ধি করতে পারবে না।  

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন না হলে বাঙালি নারী জাগরণ এত অল্প সময়ে আসত না। বাঙালিদের এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে রোকেয়া যে পরিমাণ ভূমিকা পালন করেছেন, তার উল্টো ভূমিকাটা আমরা রেখেছি। রোকেয়াকে অবহেলা, উপেক্ষা, ভুল ব্যাখ্যা করাসহ যা হয়েছে, সবগুলো হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। বেসরকারিভাবেও রোকেয়াকে অবহেলা করা হয়েছে, তবে তার দায়ও কিন্তু রাষ্ট্রের। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নামে রাষ্ট্রীয়ভাবে পদক দেওয়া হয়, কিন্তু সেটির নাম দেওয়া হয়েছে বেগম রোকেয়া পদক। তার নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেখানেও বেগম শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এটি শুধু অসচেতনতা, উপেক্ষা কিংবা অবহেলা নয়, এটি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে রীতিমতো অপরাধমূলক আচরণ। এই পরিস্থিতিতে বাংলা একাডেমি একটা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু সেই বাংলা একাডেমিও ভুল করছে। আমরা মনে করি রোকেয়ার প্রকৃত নামেই রোকেয়া চর্চাটা হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

এদিকে বাংলা একাডেমির পক্ষে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা উপপরিচালক আব্দুল্ল্যাহ আল ফারুক রোকেয়াকে নিয়ে তথ্যের অসঙ্গতির কথা স্বীকার করলেও দায় নিতে আপত্তি জানান। তিনি বলেন, ভুল রয়েছে, তার জন্য বাংলা একাডেমি দায়ী নয়। পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনা বোর্ডকে চিঠি লিখেও তথ্য সংশোধন করা সম্ভব হয়নি। এটি তাদের অবহেলা।

প্রসঙ্গত, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সে সময় মুসলিম সমাজে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কোনো চল ছিল না। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও পরিবারের সবার অগোচরে বড় ভাইয়ের কাছে উর্দু, বাংলা, আরবি ও ফারসি পড়তে এবং লিখতে শেখেন তিনি। তার জীবনে শিক্ষালাভ ও মূল্যবোধ গঠনে তার ভাই ও বড় বোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। পরবর্তীতে বিহারের ভাগলপুরে সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়। স্বামীর উৎসাহে ও নিজের আগ্রহে তিনি লেখাপড়ার প্রসার ঘটান। রোকেয়া ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মারা যান।

রোকেয়া ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জরিপে ষষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে পরিচিত। তার উল্লেখযোগ্য রচনা হলো ‘মতিচূর’, ‘সুলতানার স্বপ্ন’, ‘পদ্মরাগ’, ‘অবরোধ-বাসিনী’। ১৯৭৪ সাল থেকে পায়রাবন্দবাসী রোকেয়ার স্মরণে রোকেয়া দিবস পালন করে আসছেন। সরকারিভাবে ১৯৯৪ সাল থেকে জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় বেশ ঘটা করেই দিবসটি পালন করা হয়। সারা দেশে দিনটি উদযাপন করা হয় রোকেয়া দিবস হিসেবে।

এসপি