আজকের রাঙ্গামাটি শহরের ইতিহাস প্রায় ৩১৮ বছরের পুরোনো। এই শহরের বিবর্তনের ইতিহাস হয়তো ধারাবাহিকভাবে কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি চাপালিশ গাছ। যার কাছে জমা আছে ৩১৮ বছরের ইতিহাস।  

জানা গেছে, রাঙ্গামাটি শহরের আকর্ষণীয় যে কয়টি পর্যটন স্পট রয়েছে, তার মধ্যে ডিসি বাংলো পার্কের অবস্থান সবার ওপরে। পর্যটকদের পাশাপাশি শহরের মানুষদের কাছে বৈকালিক অবকাশ যাপনের জন্য পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে পার্কটি। এই পার্কের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ৩১৮ বছর বয়সী একটি চাপালিশ গাছ। সুপ্রাচীন এই গাছটির দৈর্ঘ্য ১০৩ ফুট ও পরিধি ২৫ ফুট।

গাছটির গোড়া ইটের গোল দেয়াল দিয়ে পরিবেষ্টিত। বিশাল গাছটির ছায়ায় যেখানে বসে উপভোগ করা যায় কাপ্তাই হ্রদের নীল জলরাশি ও শরীর জুড়ানো শীতল বাতাস। প্রতিদিন স্থানীয় ও রাঙ্গামাটির বাইরে থেকে আসা অনেক পর্যটক ভিড় করেন এই ডিসি বাংলো পার্কে। যারাই আসেন তাদের কাছে এক বিস্ময়ের নাম সুপ্রাচীন চাপালিশ। বর্তমানে গাছটিতে গজিয়েছে অনেক পরগাছা। অসংখ্য পাখির নিরাপদ আশ্রয়স্থলওই গাছটি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাছে বাস করা পাখিদের কলকাকলিতে মুখর থাকে এলাকা। 

এই গাছ সর্ম্পকে বলতে গিয়ে রাঙ্গামাটি প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক সুনীল কান্তি দে বলেন, যখন থেকে আমাদের জায়গা বা গাছ চেনার বয়স হলো, তখন থেকেই এই জায়গায় চাপালিশ গাছটি দেখে আসছি। এই গাছটি অনেক স্মৃতি বহন করে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি। রাঙ্গামাটির শহীদ আবদুল আলী একাডেমি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আলী সাহেবকে পাকিস্তানি সেনারা এই গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে দিনের পর দিন নির্যাতন করে মেরে ফেলে। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে পুরাতন রাঙ্গামাটি শহর পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার সাক্ষীও এই গাছটি। তাছাড়া শ্রদ্ধেয় বনভান্তের প্রথম চীবর গ্রহণের স্মৃতিও রয়েছে গাছটিকে ঘিরে। 

তিনি আরও বলেন, এই গাছটি সংরক্ষের বিষয়টি কিছুটা দায়সারা গোছের। যেহেতু গাছটি অনেক স্মৃতিবিজড়িত এবং এর পাশেই ডিসি বাংলো পার্ক রয়েছে, তাই গাছটির শিকড়সহ পুরো গাছটি আরও ভালোভাবে সংরক্ষণের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। 

স্থানীয় বাসিন্দা বিজয় কর বলেন, গাছটিকে জন্মলগ্ন থেকে দেখে আসছি। ভাবতেই অবাক লাগে গাছটির বয়স আজ ৩১৮ বছর। রাঙ্গামাটি শহরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছটি। আমরা বিকেলে গাছটির নিচে এসে বসি।

আরেক স্থানীয় যুবক রিকেল ত্রিপুরা বলেন, রাঙ্গামাটির সর্বপ্রাচীন এই গাছটি জেলার সব ইতিহাস বুকে লালন করে আছে। গাছটিতে এখন প্রচুর পরগাছা জন্মে এর সৌন্দর্য এবং বিশালতা ঢাকা পড়ে গেছে। গাছটির আগাছা পরিষ্কার করে যদি সংরক্ষণ করা যায়, তবে এটি ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেবে।

রাঙ্গামাটির পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের পরিচালক ফজলে এলাহি বলেন, রাঙ্গামাটি শহর কিন্তু কাপ্তাই হ্রদের নিচে বিলীন হয়ে গেছে। এই নতুন শহরে পুরাতন কোনো স্মৃতি যদি থেকে থাকে, তবে তার মধ্যে অন্যতম হলো সুপ্রাচীন চাপালিশ গাছটি। সেই সময় ডিসি বাংলো এবং ডিসি বাংলো সংলগ্ন এই চাপালিশ গাছটি পাহাড়ের উপরে থাকাতে ডুবে যায়নি। রাঙ্গামাটির পাহাড়ের উপরে (টপ সয়েলে) কিন্তু কোনো বড় গাছ জন্মায় না। সেক্ষেত্রে এই চাপালিশ গাছটি আজ প্রায় ৩১৮ বছরের মতো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ থেকে অনেক বছর পরও যদি কেউ রাঙ্গামাটি শহরের ইতিহাস লিখতে যায়, তবে চাপালিশ গাছটিকে অস্বীকার করা বা বাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
 
রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন বলেন, চাপালিশ মূলত কাঁঠাল প্রজাতির বৃক্ষ। তবে চাপালিশ গাছের উচ্চতা কাঁঠাল গাছের চেয়ে অনেক বেশি হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম অর্টোকারপাস চামা। চাপালিশ গাছ বন্যপ্রাণীদের কাছে নিরাপদ আবাসস্থল ও এই গাছের ফল তাদের খাদ্যতালিকার অংশ। যত্ন করতে পারলে এই গাছ দীর্ঘ বছর ধরে বেঁচে থাকে। 

মিশু মল্লিক/এসপি