কাজের সন্ধানে আফ্রিকার দেশ লিবিয়া গিয়ে মাফিয়া চক্রের হাতে পড়ে লাখ লাখ টাকা হারাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। অভিযোগ রয়েছে, লিবিয়ায় মাফিয়া চক্রে রয়েছে বাংলাদেশের মাদারীপুরের দালালরাও। 

টাকার জন্য চলে সেখানে অমানুষিক নির্যাতন। দেশে থাকা তাদের পরিবারের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে মোবাইলে ভিডিও কলে দেখানো হয় নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র। একপর্যায়ে পরিবারের সদস্যরা কিছুদিনের মধ্যে মুক্তিপণের টাকা পাঠাতে বাধ্য হয়। এরপর মিলে বন্দিদের মুক্তি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বন্দিদের নির্যাতন করা এক যুবকের নাম আজিজুল হক নির্ঝর (২৮)। তিনি মাদারীপুর সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের চরনাচনা গ্রামের ১নং ওয়ার্ডের আবুল কালাম হাওলাদারের ছেলে। লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের শহর জোয়ারা ক্যাম্পের মাফিয়া শরীফ হোসেনের সহযোগী ছিলেন তিনি। সেখানে তার দায়িত্ব ছিল বন্দিশালার বন্দিদের নির্যাতনের মাধ্যমে আট থেকে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করা। যারা টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানাতেন, তাদের মুখ-হাত বেঁধে করা হতো নির্মম নির্যাতন।

মাফিয়া শরীফ হোসেন

জানা গেছে, ভুক্তভোগীদের প্রথমে ঝুলানো হতো লোহার আড়ার সঙ্গে। এরপর প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় বেদম মারধর করা হতো। নির্যাতন করার জন্য শরিফ মাফিয়া নির্ঝরকে দিত প্রতি ঘণ্টায় ৩০ হাজার টাকা। মুক্তিপণের টাকার জন্য নির্ঝর ছাড় দেয়নি তার একই এলাকাসহ আশেপাশের সাত থেকে আট যুবককেও। তারা হলেন- ছিলারচর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর মোড়ল কান্দি ৩নং ওয়ার্ডের নুরুল হক মোড়লের ছেলে নাসিম মোড়ল, রেজাউল মোড়লের ছেলে রানা ইসলাম, মুজ্জাফার মোড়লের ছেলে শাহ আলম মোড়ল, রহিম মোড়লের ছেলে শফিকুল, আমিন উদ্দীন হাওলাদরের ছেলে সরোয়ার হাওলাদারসহ বেশ কয়েকজন। নির্ঝর তার নিজ এলাকা ছাড়াও অন্যান্য জেলার মানুষদেরও মুক্তিপণের জন্য নির্মমভাবে নির্যাতন করত।

এদিকে, জাহাঙ্গীর শেখ (২৮) মুন্সিগঞ্জ জেলার মোল্লাকান্দি এলাকার সেলিম শেখের ছেলে। লিবিয়ার বন্দিশালায় থাকাকালীন আজিজুল হক নির্ঝরের দ্বারা নির্যাতনের শিকার তিনি। ভাগ্য পরিবর্তনে স্থানীয় দালাল আলমগীর হোসেনের মাধ্যমে ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর কাজের সন্ধানে যান লিবিয়ায়। সেখানে গিয়ে মাফিয়ার হাতে পড়ে নির্যাতনের স্বীকার হন। পরে টাকার বিনিময়ে লিবিয়ার বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে হাইতেম নামের এক দালালের মাধ্যমে ২০২২ সালের ৬ এপ্রিল পৌঁছান ইতালিতে। দীর্ঘদিন তিনি ইতালির একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

ভুক্তভোগী জাহাঙ্গীর শেখ বলেন, নির্ঝর এতটাই পাষাণ যে কাউকেই ছাড় দিত না। মুরুব্বি বয়সের লোকজনকেও টাকার জন্য প্রচুর মারধর করত। বন্দিদের গলায় পা দিয়ে, দাড়ি টেনে, কাঠের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে নির্যাতন চালাত। আমরা হয়তো ভুল করে এ পথে এসেছি। কিন্তু সে (নির্ঝর) বাঙালি হয়েও টাকার জন্য আমাদের নির্যাতন করেছে। প্রশাসনের কাছে আমরা এর বিচার চাই।

আরেক ভুক্তভোগী মোস্তফা কামাল (৩২)। তিনি কক্সবাজার চকরিয়ার বাসিন্দা। ২০১৪ সালে লিবিয়া যাওয়ার পর থেকে সেখানেই রঙের কাজ করতেন। কাজে যাওয়ার সময় তাকে ধরে নিয়ে যায় মাফিয়া শরীফ হোসেনের লোকজন। তিনিও নির্ঝরের নির্যাতনের শিকার হন। পরে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে মুক্তি মেলে। মোস্তফা কামাল বলেন, অন্ধকার কক্ষে আটকে রাখা হতো। খাবার-পানি দিত না। মুক্তিপণের টাকার জন্য এত মেরেছে যে এখনও শরীরে দাগ রয়েছে। আমি নির্ঝরের বিচার চাই।

এদিকে, ভুক্তভোগী সোবহান হাওলাদারের বাবা আমিন উদ্দীন হাওলাদার বলেন, টাকার জন্য যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, চোখে দেখলে কোনো বাবা ঠিক থাকতে পারবে না। ভিডিও কল করে আমার ছেলেকে আমাদের চোখের সামনে মেরেছে নির্ঝর। আমরা তার বিচার চাই।

ভুক্তভোগী রানা ইসলামের মা কোহিনূর বেগম বলেন, আমার স্বামী ঢাকার শহরে রিকশা চালায়। ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর জন্য ধারদেনা করে দালাল শাহ আলমকে টাকা দেই। কিন্তু সে আমার ছেলেকে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এরপর মাফিয়া নির্ঝর টাকার জন্য আমার ছেলেকে অনেক নির্যাতন করে। আমার ছেলে বলতো, ‘মা আমাকে মেরে ফেল, না হয় টাকা দিয়ে আমাকে বাঁচাও।’ আমি নির্ঝরের শাস্তি চাই।

আরেক ভুক্তভোগী শফিকুলের বাবা রহিম মোড়ল বলেন, আমার ছেলেকে শাহ আলমের মাধ্যমে আট লাখ টাকা দিয়ে লিবিয়ায় পাঠায়। কিন্তু তাকে মাফিয়ার কাছে বিক্রি করে দেয়। মাফিয়ারা ভিডিও কলে আমার ছেলেকে এমনভাবে নির্যাতন করে যে তা দেখে আমি বেহুঁশ হয়ে পড়ি। নির্ঝর কীভাবে এ কাজটা করল? প্রশাসনের কাছে আমরা তার বিচার চাই।

মাদারীপুর সদর উপজেলার হোসনাবাদ এলাকার রাকিব ফরাজী নামের আরেক ভুক্তভোগী বলেন, শরীফের ক্যাম্পে আমি বন্দি ছিলাম। দুই মাসের মধ্যে নির্ঝরের নির্যাতনে সেখানে দুটি ছেলে মারা যায়। 

সম্প্রতি মাদারীপুরে নিজ বাড়িতে ফিরেছে মাফিয়া চক্রের সদস্য অভিযুক্ত আজিজুল হক নির্ঝর। তার কাছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কাজ করার জন্য লিবিয়া গিয়েছিলাম। আমাকে ইতালি যাওয়ার পথে মাফিয়ারা আটক করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তারপর আমাকেসহ অনেককে মারধর করে। আমি আরবি ভাষা জানতাম বলে আমাকে কম মারধর করে। সেখানে ভুক্তভোগীরা কান্নাকাটি আর চিৎকার করত। মাফিয়া শরিফ আমাকে সবাইকে চুপচাপ রাখার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিল।

নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায়ের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, টাকা-পয়সার ব্যাপারে আমি কিছু জানতাম না। তবে, শুনেছি ওখানে সাড়ে আট থেকে ১০ লাখ টাকা করে নেওয়া হতো। আমি কারও কাছ থেকে কোনো টাকা-পয়সা নেইনি। আমি শুধু সবাইকে চুপচাপ থাকার জন্য শাসন করেছি। ক্যাম্পে ভালো সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে এ কাজ করেছি। কেউ যদি আমার নামে অভিযোগ করে থাকে সেটা মিথ্যা।

এ বিষয়ে মাদারীপুর জেলা পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব। মানবপাচার রোধে আমরা বদ্ধপরিকর। মানুষকে আটক রেখে জিম্মি করে টাকা নেওয়া অনৈতিক কাজ। এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাই আমরা আইনের মধ্য থেকে মানবপাচারকারীদের গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করছি। ইতোমধ্যে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিভাবকদের উদ্দেশে অনুরোধ করব, তারা যেন অবৈধ পথে তাদের সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে না দেয়।

রাকিব হাসান/এফকে