মিনা বেগম ও তার স্বামী হাসিবুল ইসলাম

প্রায় ২৫ বছর ধরে রাজশাহী নগরীর পদ্মাপাড়ে কালাই রুটি বিক্রি করছেন মিনা বেগম। রাজশাহী এসে তার হাতের কালাই রুটি খেয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ওই সময় মন্ত্রীর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হন রুটি বিক্রেতা মিনা বেগম। এতে তার বিক্রি বেড়েছে কিছুটা। কিন্তু ফেরেনি ভাগ্য। রোগশোক বয়ে আজও একা হাতে সংসারের ঘানি টেনে চলেছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এই নারী।

মিনা বেগম নগরীর শ্রীরামপুর পদ্মাপাড়ের বাসিন্দা। তার স্বামীর নাম হাসিবুল ইসলাম (৬০)। সরকারি জায়গায় কোনো রকমে ঘর তুলে পরিবার নিয়ে বাস করছেন মিনা। তার স্বামী হাসিবুল ইসলাম একসময় রিকশা চালাতেন। কিন্তু তার শরীরে জটিল-কঠিন রোগ বাসা বাঁধায় ১০ বছর ধরে হাঁটাচলাও করতে পারেন না ঠিকমতো।

সংগ্রামী মিনা বেগমের স্বপ্নের শুরুটা ঠিক এমন ছিল না। আরসব বাঙালি নারীর মতোই সুখী সংসারের স্বপ্ন দেখতেন তিনিও। বয়স তখন তেরো কি চৌদ্দ। পরিবারের ইচ্ছায় ওই বয়সেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। কৈশোর না পেরোতেই স্বামী-সংসার।

বাবার বাড়ি জেলার গোদাগাড়ীর প্রেমতলি ছেড়ে স্বামীর বাড়ি নগরীর ডিঙ্গাডোবায় এসে ওঠেন মিনা। তার স্বামী তখন থেকেই রিকশা চালাতেন। স্বামীর আয়ে কোনো রকমে সচল ছিল সংসারের চাকা। একে একে তাদের ঘর আলো করে আসে চার ছেলে। কিন্তু অভাবের সংসারে নিত্য টানাপোড়েন লেগেই থাকত। এ কারণে ছেলেদের পড়ালেখাও করাতে পারেননি।

এই দম্পতি চার ছেলের জনক। বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন তিন ছেলে। মেজও ছেলে রায়হান আলী রানা (২৬) স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মা-বাবার সঙ্গেই থাকেন। একসময় নগরীর সাহেববাজার এলাকায় ভাসমান চটপটি ও ফুচকা বিক্রি করতেন রানা। সিটি করপোরেশন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সময় তার দোকানটি তুলে দেয়। এরপর থেকে তিনিও বেকার।

রুটি বানাচ্ছেন মিনা বেগম

রিকশা চালিয়ে স্বামী আর সংসারে সামলাতে পারছিলেন না। ওই সময় কিছু একটা করে টিকে থাকার সংগ্রামে নামেন মিনা। প্রায় তিন দশক আগের কথা। শুরু করেন ভাপা পিঠা বিক্রি। বেশ ভালোই চলছিল বেচাকেনা। কিন্তু সংসার চলছিল না।

এরপর একসময় শুরু করেন কালাই রুটি বানানো। প্রায় ২৫ বছর ধরে তিনি কালাই রুটি তৈরি করে বিক্রি করছেন পদ্মাপাড়ে। একপর্যায়ে স্বামী অসুস্থ হয়ে রিকশা চালানো ছেড়ে দেন। এরপর সংসারের দায়দায়িত্ব এসে যায় তার কাঁধে। এরপর থেকেই সংসার চলছে মিনা বেগমের একার আয়ে।

এখন নগরের সিঅ্যান্ডবি মোড়-সংলগ্ন পদ্মাপাড়ের গাছতলায় পলিথিন টাঙিয়ে কালাই রুটি তৈরি করেন মিনা। পাশেই সরকারি বাংলো। বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি থেকে শুরু করে বড় কর্মকর্তারা তার হাতের রুটি খান। রুটি খান শিক্ষার্থীরা, এমনকি রিকশাচালকও গাছতলায় বসেই তৃপ্তি করে তার হাতের কালাই রুটি খেয়ে যান।

মিনা বেগেমের হাতের একেকটা স্পেশাল কালাই রুটির দাম ৩০ টাকা। আর সাধারণ রুটি বিক্রি হয় ২০ টাকায়। বেগুনভর্তা, কাঁচামরিচ ও ধনেপাতার চাটনি দিয়ে রুটি পরিবেশন করেন মিনা বেগম। ভোর ছয়টা থেকে শুরু করে রাত নয়টা পর্যন্ত জ্বলে তার চুলা।

রাজশাহীতে এসে ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মিনা বেগমের হাতে বানানো কালাই রুটি খান। সেই স্বাদ তিনি ভুলতে পারেননি। দুই বছর পর ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর আমতলায় বসে আবারও মিনা বেগমের কালাই রুটির স্বাদ নেন মন্ত্রী।

সেদিনের কথা মনে করে মিনা বেগম ঢাকা পোস্টকে জানান, সেদিন ভোরবেলা তিনি রুটি বানাচ্ছিলেন। সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসে চার-পাঁচজন রুটি খাচ্ছিলেন। পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক ব্যক্তি। ফিরে এসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি এখানে রুটি খেতে পারি? সামনে বসা লোককজন তাকে ডেকে রুটি খেতে বসালেন। রুটি খেয়ে যাওয়ার সময় ওই ব্যক্তি দুই হাজার টাকা ধরিয়ে দেন। তিনি আগন্তুককে চিনতেই পারেননি।

পরে আরেক দিন তিনি এলেন। সেদিনও রুটি খেলেন ওই লোক। এবার তিনি তাকে চিনতে পারেন যে তিনি ওবায়দুল কাদের। কথা বলার একফাঁকে মন্ত্রীর কাছে বেকার ছেলের জন্য চাকরি চান মিনা। এরপর মন্ত্রী মিনার সামনে থাকা অবস্থাতেই ছেলের চাকরির জন্য রাজশাহীর জেলা প্রশাসককে ফোন দেন। জেলা প্রশাসকও চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দেন।

মিনা বলেন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পিয়ন ও নাইটগার্ড পদে তার ছেলে আবেদন করেন। কিন্তু চাকরি আর হয়নি। যাওয়ার সময় তাকে ওবায়দুল কাদের নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে গিয়েছিলেন। বহু চেষ্টা করেও ওই নম্বরে সংযোগ পাননি। সংযোগ পেলে হয়তো ছেলের চাকরিটা হয়ে যেত। তার পরিবারটিও রক্ষা পেত।

সে সময় গাছতলায় বসে মন্ত্রীর কালাই রুটি খাওয়ার ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন লোকজন। তারপর থেকেই এখন দূরদূরান্ত থেকে লোকজন রুটি খেতে আসেন। এতে আগের চেয়ে বিক্রিও বেড়েছে। অনেকেই তাকে জিজ্ঞেস করেন, মন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ছেলেকে চাকরি হয়েছে কি না। তিনি জানান, চাকরি এখনো হয়নি। হয়তো একদিন হবে।

মিনা বেগমের দোকানে কালাই রুটি খাচ্ছেন দুই ক্রেতা

মিনা বেগমের রুটির দোকানে টুকটাক সহায়তা করেন তার স্বামী হাসিবুল ইসলাম। অসুস্থতায় একেবারেই নুয়ে পড়েছেন তিনি। মিনা বেগমের ভাষ্য, ১০ বছর ধরে তার স্বামী অসুস্থ। এখন অবস্থা আরও খারাপ। ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট ও লিভারেও সমস্যা আছে। তার দুটি কিডনিই নষ্ট। মাসে অন্তত সাত-আট হাজার টাকার ওষুধ লাগে।

চিকিৎসায় খরচ হয় মোটা টাকা। রুটি বিক্রির এই আয়েও সংসার চলে না। তার ওপর স্বামীর চিকিৎসা। যেদিন স্বামীর ওষুধ কেনেন, সেদিন প্রায় না খেয়েই কাটাতে হয় তাদের। ছেলেরা মাঝেমধ্যে কিছু টাকা দেন। সেটাও প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য।

করোনা মহামারিতে যেখানে সবারই জীবনে নেমে আসে দুর্গতি, সেখানে মিনা বেগম কাটিয়েছেন আরও দুর্বিষহ জীবন। তিনি জানান, করোনাকালেও তিন মাস চুলা জ্বালাতেই পারেননি। যারা তার কাছে নিয়মিত রুটি খেতেন, তারা যোগাযোগ করে কিছু সহায়তা দিয়েছেন। তারপরও অনেক কষ্টে পরিবার নিয়ে দিন পার করছেন। আগের চেয়ে লোকজন কমেছে পদ্মাপাড়ে। সেই সঙ্গে বিক্রি কমে গেছে।

এদিকে দ্বিতীয় দফা যখন মিনা বেগমের দোকানে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আসেন, তখন তার সঙ্গে ছিলেন জেলার পবা উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা সঈদ আলী রেজা। চাকরির আশায় বহুবার তার কাছেও গিয়েছেন মিনা বেগমের ছেলে রায়হান আলী রানা।

এ নিয়ে কথা হয় রানার সঙ্গেও। তিনি বলেন, অনেকবার মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে তারা যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কিছুতেই সংযোগ পাননি। তিনি বারবার পবা উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার কাছেও গেছেন। গেলেই বলতেন, এবার না হলে পরের বার চাকরি হবে। কিন্তু চাকরি আর হয়নি।

বিষয়টি স্বীকার করেছেন পবা উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা সঈদ আলী রেজা। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনি তৎকালীন জেলা প্রশাসককে বলেছিলেন ওই যুবকের চাকরির জন্য। কিন্তু কেন তার চাকরি হয়নি, তিনি জানেন না। তবে ওই সময় মন্ত্রীর কাছে ছেলের চাকরির জন্য পাটকলের এক শ্রমিকও গিয়েছিলেন। এরই মধ্যে ওই শ্রমিকের ছেলের চাকরি হয়েছে। সুযোগ থাকলে আবারও মিনা বেগমের ছেলের চাকরির জন্য তিনি চেষ্টা করবেন বলেও জানান সঈদ আলী রেজা।

এনএ