যে হাতে থাকার কথা ছিল বই-খাতা, সেই হাতে মাছ ধরার জাল। যে হাতে ছবি আঁকার কথা ছিল, সেই হাতে নৌকার বৈঠা। মাছ ধরা জালের প্রতিটি সুতায়  মিশে আছে প্রান্তিক শিশুদের কষ্ট। অর্থাভাবে এভাবেই শৈশব হারাচ্ছে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার শিশুরা।

হাতিয়া উপজেলার উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ শিশু মাছ ধরার পেশায় জড়িত। পরিবারের অভাবের কারণেই শিশুরা এ পেশায় যুক্ত হচ্ছে। যে সময় শিশুদের স্কুলে থাকার কথা, সেই সময় তারা নদী কিংবা সাগরে মাছ ধরতে ব্যস্ত থাকে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এসব শিশুকে স্কুলে ফেরাতে সরকারের পক্ষ থেকে উপবৃত্তিসহ নানা ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এই কাজে জড়িত শিশুদের কোনো পরিসংখ্যান নেই উপজেলা মৎস্য অফিসে।

হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাটে কথা হয় ১২ বছরের শিশু আবদুল্লাহর সঙ্গে। সে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি কোন ক্লাসে পড়তাম এখন আর মনে নেই। মাছ ধরে আমার সংসার চলে। গরিব মানুষ ভাই আমরা। নৌকা ছাড়া আর কিছু বাইতে জানি না, পড়ালেখাও জানি না। 

হৃদয় নামের ১৪ বছরের আরেক শিশু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি মাদরাসায় পড়ালেখা করেছি। এখন যদি মাদরাসায় থাকতাম তাহলে ১০ম শ্রেণিতে থাকতাম। পেটের দায়ে নদীতে এসেছি। পড়ালেখা করে কী লাভ? আগে তো পেট বাঁচাতে হবে। আমার সংসারে আমি বড় ছেলে। বাবা নাই তাই ৪ সদস্যের সংসার আমাকে দেখতে হয়। আমি মাছ ধরে যে টাকা পাই তা দিয়েই সংসার চলে।

৮ বছরের শরিফুল নামের এক শিশু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার পড়ালেখা করতে ভালো লাগে না। কাজ করতে ভালো লাগে, মাছ ধরতে ভালো লাগে। স্কুলে যাই নাই, নদীতে নামি মাছ ধরি। 

১২ মাস নদীতে নৌকায় বসবাস করেন জরিমন বেগম (৩৫)। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তার। তার বড় ছেলে পিন্টু ঢাকা পোস্টকে বলেন, বান তুফানে আমরা নদীতে বাস করি। বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করব এমন কপাল আমাদের নাই। যত ঝড় বৃষ্টি আসুক নদীতে থেকেই জীবন চালাতে হয় আমাদের।

জরিমন বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কষ্টে দিন যাইতেসে। আমাদের কোনো সুখ নাই। নদী ভেঙে যাদের ঘর-বাড়ি চলে যায় আমরা তাদের থেকেও খারাপ। আমরা পোলাপানদের পড়াইতে পারি না। খাইতে পারি না আবার পোলাপাইন পড়ামু কেমনে? পড়ালেখা করানোর তৌফিক আমাদের নাই।

সাইফুল ইসলাম (২০) নামের এক জেলে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এখানে স্কুল কম। স্কুল কম হওয়ায় কিছু ছেলেরা যায় আবার কিছু যায় না। কয়েকদিন গেলে টাকা পয়সার জন্য নদীতে চলে আসে। নদীতে আসলে দিনে ২০০ টাকা করে হলেও মাসে ৬০০০ টাকা। সংসার চলে এই টাকায়।

হৃদয়ের চাচা মনু মাঝি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সংসারে অভাব দেখে হৃদয় পড়ালেখা বাদ দিয়ে মাছ ধরে। ওর বাবা ওদের ফেলে চলে গেছে। তাই পড়ালেখা না করে মাছ ধরতে হয়।

নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের শতফুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোজাক্কের হোসেন রতন ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে বয়সে ছাত্র-ছাত্রীরা বা ছোট বাচ্চারা বই খাতা নিয়ে স্কুলে যায় সেই বয়সে তারা জাল নৌকা নিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করে। ফলে তাদের জীবন নিম্নগামী হয় এবং ভবিষ্যৎ বলতে কিছু থাকে না।

হরণী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আখতার হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে ছেলেদের প্রাইমারি অথবা মাদরাসায় লেখাপড়ার কথা ছিল তারা এখন জেলের কাজে জড়িত হয়ে গেছে। কেউ ভাত রান্না করে, কেউ জালের আবর্জনা পরিষ্কার করে। দারিদ্র্যতা ও পেটের ক্ষুধার কারণে এসব মাছুম বাচ্চারা জেলের কাজে আসছে। আমাদের অনেক জায়গা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি-স্কুলসহ নানান গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে। ফলে তারা বেঁড়ির কূলে যাযাবর জীবন যাপন করছে। এসব পরিবারের শিশুরা জেলে কাজে জড়িত হচ্ছে।

হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সবাই যেনো শিক্ষার আওতায় আসে সেইজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপবৃত্তিসহ নানান কর্মসূচির ব্যবস্থা করেছেন। এমনকি আমাদের হাতিয়া উপজেলায় প্রাথমিকে শতভাগ উপবৃত্তি দেওয়া হয়। যা দেশের অনেক উপজেলায় নেই।

মো. সেলিম হোসেন আরও বলেন, আমরা খবর পেয়েছি অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে এবং শিশু শ্রমে যুক্ত হয়েছে। জন প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে যারা জেলে কাজে রয়েছে তাদের বিদ্যালয় ফেরাতে চেষ্টা করব এবং সবাইকে উপবৃত্তির আওতায় নিয়ে আসব। আমি কথা দিচ্ছি, উপজেলা প্রশাসন থেকেও যাদের আর্থিক সমস্যা রয়েছে তা সমাধানের চেষ্টা করা হবে। আশা করি এতে হাতিয়ায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থী ও শিশুশ্রম শূন্যের কোঠায় চলে আসবে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ফেরদৌসী বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষার সঙ্গে শিশুদের সম্পৃক্ত রাখতে সরকারের নানামূখী কর্মসূচি রয়েছে। তবে এসব বাস্তবায়নে নদী ভাঙন ও দুর্গম চরাঞ্চল এলাকায় আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। ভাঙন কবলিত এলাকার শিশুরা পরিবারের অভাবের কারণে বিদ্যালয়ে আসার সুযোগ পায় না। সেখানে এনজিওসহ বেসরকারি কিছু কর্মসূচি রয়েছে। অভিভাবকদের সচেতনতার পাশাপাশি সরকারের 'সবার জন্য শিক্ষা' বাস্তবায়নে প্রণোদনা দেওয়া যায় কিনা দেখা উচিৎ। 

আরকে