নিজের লেবু বাগানে সফল উদ্যোক্তা আশরাফ আলী

সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা জেলা ঝিনাইদহ। এ জেলায় বিভিন্ন ধরনের ফসলের চাষ হয়ে থাকে। জেলার ছয়টি উপজেলার মানুষ কৃষি ওপর নির্ভরশীল। তবে মহেশপুর উপজেলা হচ্ছে কৃষির ভান্ডার। মহেশপুর উপজেলার আয়তন ৪১৯ দশমিক ৫৩ বর্গকিলোমিটার। এই উপজেলার ৩৩ হাজার ৬৭৭ হেক্টর জমিতে আবাদ হয় বিভিন্ন ফসল।

মহেশপুর উপজেলার স্বরূপপুর ইউনিয়নের কসুমপুর গ্রামের এমনই এক সফল উদ্যোক্তা আশরাফ আলী। ২২ বিঘা জমিতে নার্সারি ও ফলের বাগান করে তিনি আজ সফল নার্সারি ও ফলচাষি। তার বাগানে কাজ করছেন ৩০ থেকে ৪০ জন শ্রমিক। বর্তমানে তার বার্ষিক আয় গড়ে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। তার উৎপাদিত গাছের চারা ও সুস্বাদু ফল জেলার চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে সারাদেশে।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আশরাফ আলী বলেন, সংসারের অভাবের কারণে বেশি লেখাপড়া করতে পারিনি। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে আমি ছিলাম ভাইদের মধ্যে তৃতীয়। আমার অনেক ইচ্ছা থাকার পরও সংসারের অভাবের কারণে লেখাপড়া করতে পারিনি। ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই আমাকে মানুষের কৃষিজমিতে শ্রমিকের কাজ করতে হয়েছে। আমি কখনো খেয়ে কখনো না-খেয়ে মানুষের কাজে যেতাম। শুধু দিনমজুরের কাজ করে সংসার না চলায় আমি মাঠের কাজ ছেড়ে ১৯৯৪ সালের দিকে ফ্রেন্ডস নার্সারিতে দৈনিক মুজরিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করি।

তিনি আরও বলেন, সেখানে তিন বছর কাজ করার পর ১৯৯৭ সালে কাজ ছেড়ে দিয়ে আমার বাবার কাছ থেকে ১০ শতাংশ জমি নিই নার্সারি করার উদ্দেশ্যে। এরপর ১৯৯৮ সালে আমি নার্সারি শুরু করি। প্রথমে আম, কাঁঠাল, লিচু, মেহগনি, শিশুসহ বেশ কিছু গাছের চারা লাগাই। প্রথমেই ১০ শতকের চারা বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা লাভ পাই।

আশরাফ আলীর নার্সারিতে কাজ করছেন শ্রমিকরা

এরপর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ওয়েভ ফাউন্ডেশন নামের একটি এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিই সহজ শর্তে। তারপর থেকে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। সেখান থেকে আজ পর্যন্ত আমাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।

আশরাফ আলী বলেন, এই ২৩ বছরে নার্সারি ব্যবসা করে আমি আজ ১২ বিঘা জমির মালিক। এ ছাড়া আরও ১২ বিঘা জমি লিজ নিয়ে বিভিন্ন ফলের বাগান করেছি। সেই ফলের বাগানের মধ্যে লাভজনক ফল হচ্ছে লেবু। লেবুতে দিগুণ লাভ। আমার আয় দিয়ে আমার ছেলেকে বাজারে একটা কাপড়ের দোকান করে দিয়েছি। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। নিজে ২২ লাখ টাকা দামের একটা ট্রাক কিনেছি, যাতে নার্সারির উৎপাদিত চারাগুলো দেশের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে দিতে পারি।

আশরাফ আলী নার্সারির পাশাপাশি বিভিন্ন ফলের বাগান করেছেন। তিনি জানান, একটি আমের চারা তৈরি করতে ১৫ থেকে ২০ টাকা খরচ হয়। সেই চারা বাজারে ৫০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়। আর যে চারাগুলো ১২ থেকে ১৫ টাকা খরচ হয়, সেগুলো ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি করা হয়। তার এসব চারা পঞ্চগড়, রাজশাহী, সিলেট, রাঙামাটিসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়।

নার্সারি ও ফলের চারার পাশাপাশি আশরাফ আলীর আছে ফলের বাগানও। এর মধ্যে বাগানের সিডলেস লেবু অন্যতম। এই সিডলেস লেবুর যেমন বাজারে চাহিদা রয়েছে, তেমনি এর দামটাও অনেক ভালো। বর্তমানে একটি লেবুর পাইকারি দাম বাজারে তিন-চার টাকা। আবার করোনাকালীন এই লেবু বিক্রি করেছেন ১০ টাকা দরে। এই লেবুটা দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও তেমন সুস্বাদু।

তিনি জানান, এক একর জমিতে লেবার খরচ, জমি চাষের খরচ, সার ও কীটনাশকের খরচ, জমির বার্ষিক খরচ বাবদ ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়। সেখানে গাছে পরিপূর্ণ ফল আসার পর ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার লেবু বিক্রি করা যায়। তিনি ১২ মাসে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার বেলু বিক্রি করছেন। আশরাফ আলী বলেন, সব মিলিয়ে আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো আছি।

নিজ জমিতে কাজ করছেন আশরাফ আলী

এলাকার স্থানীয় এক সাংবাদিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আশরাফ আলী চাচা তিন বিঘা জমির বেশি জায়গায় লেবুর চাষ করেছেন। লেবুটা দেখতেও সুন্দর আবার খেতেও অনেক সুস্বাদু। তার সফলতা দেখে আমারও ইচ্ছা জাগে একটা নার্সারি ও লেবু-বাগান করতে।

একই ইউনিয়নের শামীম শিকদার জানান, তিনি এর আগেও আশরাফ নার্সারি থেকে কুলের চারা নিয়েছিলেন। সেটা ভালো হওয়ায় এবার তিনি লেবুর চারা কিনতে এসেছেন।

আশরাফ নার্সারির কর্মী শাহাজান বলেন, আমিসহ আরও ৩০ থেকে ৪০ জন আশরাফ নার্সারিতে নিয়মিত কাজ করি। চারা দেখাশোনা করার পাশাপাশি বিভিন্ন ফল গাছের পরিচর্যা করি। আমি অশিক্ষিত হয়েও মাসে যে বেতন পাই, তাতে সংসার ভালোভাবে চলে যায়। আবার আমার পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় ফলও সেখান থেকে বিনামূল্যে নিই। আশরাফ আলীর কারণে আমাদের ৪০টি পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা বিজয় কৃষ্ণ হালধার ঢাকা পোস্টকে জানান, ঝিনাইদহ জেলায় বিভিন্ন ফসলের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে ফলের আবাদ হয়ে থাকে। জেলায় প্রায় ১৪ হাজার ৫৮ হেক্টর জমিতে ফলের চাষ হয়। তার মধ্যে ১৩৪ হেক্টর জমিতে কাগজি লেবু, থাই লেবু, সিডলেস লেবু (চায়না-৩), চায়না কমলা ও বড় কমলা লেবু চাষ হয়। আবার এখানে অনেক পরিমাণে নার্সারিও আছে।

তিনি আরও বলেন, মহেশপুর উপজেলার বিভিন্ন নার্সারির মধ্যে আশরাফ আলী নার্সারি একটি উল্লেখযোগ্য। আশরাফ আলী একজন সফল উদ্যোক্তা। তিনি নিজে সফল হচ্ছেন আবার অন্যদেরও সহায়তা করছেন। আমি আশরাফ আলী নার্সারির উত্তরোত্তর বৃদ্ধি কামনা করি।

এনএ