নাইমা সুলতানা ওরফে পাখী (২২) ফরিদপুর সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজে বাংলা বিভাগে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তবে তিনি সমাজের আর ১০ জন নারীর মতো স্বাভাবিক আকৃতির নন।

তিনি খর্বকায়, তার উচ্চতা মাত্র ২ ফুট ৫ ইঞ্চি। ওজন ২০ কেজি। তবে তার মনোবল অন্য যেকোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় অনেক বেশি।

ফরিদপুর সদরের কানাইপুর ইউনিয়নের উলুকান্দা গ্রামের নাদের মাতুব্বর ও সাহিদা বেগম দম্পতির মেয়ে নাইমা সুলতানা। নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়েও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। পড়াশুনা শেষ করে হতে চান সরকারি কর্মকর্তা।

তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ২০১৭ সালে পোরদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসিতে ৩.২৭ এবং ২০১৯ সালে ফরিদপুর মুসলিম মিশন থেকে একই বিভাগ থেকে এইচএসসিতে ৪.৩৩ পেয়ে উর্ত্তীর্ণ হন। এখন বাংলা বিভাগে স্নাতক করছেন। তার ছোট বোন ছোটবোন সামিয়া আক্তার (১৫) পড়াশোনা করছে কানাইপুরের পোরদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে। আর মেজ বোন হাফসা আক্তার (২০) ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলী মহল্লায় অবস্থিত ফরিদপুর ডায়াবেটিকস এসোসিয়েশন হাসপাতালের নার্সিং ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করছেন। তার বাবা পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী। কোনো ভাই না থাকায় পড়াশুনা করে সংসারের হাল ধরতে চান তিনি।

গত ১২ বছর আগে তার বাবার দুটি ভালভ নষ্ট হয়ে গেলে অনেক টাকা খরচ করে চিকিৎসা করানো হয় তার। তবে সুস্থ হয়ে ওঠার কয়েকমাস পর ব্রেইন স্ট্রোক করে ১২ বছর ধরে বিছানায় শয্যাগত। নাদের বিভিন্ন কৃষিপণ্যের মৌসুমী ব্যবসায়ী ছিলেন। সেই ব্যবসার কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন তিনি। সেই টাকায় কোনোভাবে তাদের সংসার চলছে। 

নাইমা সুলতানা বলেন, আমি সবসময় নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছি। কখনও কারও ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে চাইনি। আমার আকৃতি দেখে অনেকেই করুণা করে। ইচ্ছা করলে মানুষের করুণা নিয়ে কিছু না করে পথ চলতে পারতাম। তবে আমি বিশ্বাস করি ব্যক্তিভেদে মানুষের নাম যেমন আলাদা হয়, তেমনি আলাদা যোগ্যতার প্রয়োজন হয়। এজন্যই আমি জীবন যুদ্ধে নেমেছি। আমি একটা আলাদা পরিচয় চাই। যেন আমাকে দেখে মানুষ বলতে পারে শারিরীক প্রতিবন্ধকতা কোনও সমস্যা নয় যদি মনে শক্তি থাকে কিছু করার।

নাইমা জানায়, তার বাবাই সর্বপ্রথম তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। তবে তার পড়াশুনার ব্যাপারে সাহায্য করেন তার মা। ছোট শরীরের জন্য তার একার পক্ষে চলাফেরা করা কষ্টকর। মা তাকে স্কুল ও কলেজে দিয়ে যান। এখন অবশ্য কলেজের আবাসিক হলে আসন পাওয়ায় মাকে কষ্ট করতে হয় না। তবে তার সহপাঠীরা এ ব্যাপারে আমাকে সার্বিক সহযোগিতা করেন।

নাইমার মা শাহিদা বেগম বলেন, আমার মেয়ে নাইমা এখন সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজের হোস্টেলে আছে। ওখানে থেকেই পড়াশোনা করে। ওর বাবা ১২ বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছে। আমার কোনও ছেলে নেই। এই তিনটি মেয়ের পড়াশোনার খরচ, স্বামীর ওষুধ কেনার টাকা মিলিয়ে অনেক টাকা খরচ হয়। নাইমা বর্তমানে বাৎসরিক সাড়ে চার হাজার টাকার প্রতিবন্ধী ভাতা পায় এছাড়া আর কিছুই পায় না। স্বামীর কিছু সঞ্চয়, ২৫ শতাংশ কৃষিজমি থেকে বর্গা দিয়ে যা টাকা পাই তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চালাতে হয়। 

সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজের হোস্টেলে নাইমার রুমমেট উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির ছাত্রী ফাতেমা আক্তার বলেন, আমাকে বড় বোনের মত আগলে রাখেন নাইমা। আমিও নাইমা আপুর সব দিকে খেয়াল রাখি। আমাদের বন্ধুদের ঝামেলা হলে নাইমা আপুই মিটিয়ে দেন, কখনো রাগ করে খাবার না খেলে আপু খাইয়ে দেন। নাইমা আপুর মত একজন রুম মেট পেয়ে আমি ভুলে গেছি বাড়িতে আছি নাকি হোস্টেলে আছি।

কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তালুকদার আনিসুল ইসলাম বলেন, পরীক্ষার সময় খুব সিরিয়াস নাইমা। হলে অন্য মেয়েরা এদিক ওদিক তাকেলেও সে একেবারেই তাকায় না। যা বোঝে তাই লেখে। পড়াশুনার পাশাপাশি বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ করে নাইমা। সে আবৃত্তি করেন, গান গান ও নাচ করে। কলেজের বিভিন্ন সংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় সে এসব কাজের মাধ্যমে একাধিকবার পুরস্কৃত হয়েছে।

ফরিদপুর সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ কাজী গোলাম মোস্তফা বলেন, নাইমাকে হোস্টেলে ফ্রি খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। সে আমাদের কলেজের নিয়মিত শিক্ষার্থী এবং পড়াশোনার প্রতি খুবই আগ্রহী একজন ছাত্রী। এমন একাগ্রতা থাকলে সে অনেকদূর যেতে পারবে।

কানাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফকির মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, স্বামীর অসুস্থতার পরও নাইমার মা শাহিদা বেগম নিজের মনোবল দিয়ে মেয়ে তিনটিকে আলোকিত মানুষ করার জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। শাহিদা বেগমের বড় মেয়ে শারিরীকভাবে খর্বাকৃতির একজন মানুষ হওয়ার পরও থেমে থাকেনি অদম্য মনোবল নিয়ে এগিয়ে চলছেন।

ফরিদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিটন ঢালী বলেন, নাইমার বিষয়টি আমরা জানি। তার বিষয়ে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসককে অবগত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন নাইমার পাশে থাকবে সহযোগী হিসেবে।

জহির হোসেন/আরকে