মৃৎশিল্প দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও অন্যতম একটি শিল্প। কুমাররা তাদের শৈল্পিক দক্ষতা ও মনের মাধুর্য দিয়ে চোখ ধাঁধানো সব কাজ করে থাকেন। যখন কাচ, সিরামিক, মেলামাইন ও অ্যালুমিনিয়ামের প্রচলন ছিল না তখন ব্যবহারের জন্য মাটির তৈরি জিনিসপত্রই ছিল মানুষের একমাত্র ভরসা। এটি এদেশের নিজস্ব শিল্প। বর্তমানে নওগাঁর কুমাররা আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন ঐতিহ্য মৃৎশিল্প।

সরেজমিনে নওগাঁর বিভিন্ন উপজেলার কুমার পল্লী ঘুরে দেখা যায়, পেশায় নিয়োজিত মৃৎশিল্পীদের মধ্যে অধিকাংশরা হচ্ছেন পাল সম্প্রদায়ের। এক সময় নওগাঁয় শত শত কুমার মিলে তাদের শৈল্পিক দক্ষতা ও মনের মধ্যে লুকায়িত মাধুর্য দিয়ে চোখ ধাঁধানো মাটির সুন্দর সৃষ্টিশীল বস্তু গড়ে তুলতেন কিন্তু বর্তমানে চাহিদা কম থাকায় এবং আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি আর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য অন্য পেশার দিকে ছুটছেন তারা।

জেলার কুমাররা জানান, এক সময় নওগাঁর প্রতিটি উপজেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো কুমাররা। সেসময় মাটির তৈরি জিনিসের ব্যাপক চাহিদা ছিল, তারা প্রায় ১০০-১২০ জন মিলে কাজ করতেন প্রতিনিয়ত কিন্তু বর্তমানে সময়ের সাথে চাহিদা অনুযায়ী পারিশ্রমিক না পাওয়া এবং চাহিদা অনুযায়ী কাজ না থাকায় কুমারদের সংখ্যা নিতান্তই অনেক কম। বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখতে হাল ছাড়েনি অনেকেই। মাটি এবং জ্বালানির দাম বেশি হবার কারণে লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে চলতে হচ্ছে তাদের।

নওগাঁ সদর উপজেলার বালুভড়া ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রামের মৃতশিল্পী হারাধন পাল বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাটতে হয়, সেই তুলনায় টাকা হয় না। খুব বেশি পরিশ্রম করলেও ৩০০ টাকার বেশি কাজ করা যায় না, এতে সংসার চলে কোন রকমে। আবার ঋণও নিতে হয়। ৪-৫ জন মিলে একভাটা মাল তৈরি করতে ২০ দিন লেগে যায়।

হারাধন পালের স্ত্রী বলেন, গ্রামীণ মেলাতেও মাটির তৈরি জিনিস তেমন বিক্রি হয় না তাই তারা দই এর পাতিল বানায়। বাড়ি থেকেই পাতিলগুলো বিক্রি হয়ে যায়। দিনে তারা ১৫০-২০০ পাতিল বানিয়ে থাকেন কিন্ত তার অর্ধেকটা দিতে হয় মহাজনকে। একটা পাতিল ৭ টাকা দরে বিক্রি করা হয়।

নওগাঁর ঘোষপাড়ার নিতেন চন্দ্র পাল বলেন, আগে যে কাজগুলো হতো সেগুলো এখন আর হয় না। কেউ যদি খেলনা বানিয়ে নিতে চায় তাহলে আমাদের কাছে অর্ডার করলে আমরা সেটা বানিয়ে দেই। মাটি কেনার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সারাবছর কাজ করে সেটা পরিশোধ করি। এতে কষ্ট করে হলেও টেনেটুনে সংসার চালাতে হয়।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) এর নওগাঁ জেলা কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক জনাব শামীম আক্তার মামুন বলেন, বিসিক সাধারণত ক্ষুদ্র কুটির, মাইক্রো এবং মাঝারি শিল্প নিয়ে কাজ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে বিসিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেক্ষেত্রে তিনি প্রতিটি ঘর থেকেই কাজ শুরু করেছেন যেটি মূলত কুটির শিল্প, এই কুটির শিল্পের একটি বড় অংশ হচ্ছে মৃৎশিল্প। এটি আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। নওগাঁতে এটি বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তবে আধুনিকায়ন না হওয়ায় মাটির তৈরি হাড়ি-পাতিলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এ কারণে অনেকে এ পেশা থেকে চলে যাচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা আছে, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং ক্ষুদ্র লোনের ব্যবস্থা আছে। কাজ করতে ইচ্ছুক এমন কুমারদের খুঁজে বের করে আধুনিক চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে যুগোপযোগী করা সম্ভব। মৃৎশিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে গ্রামীণ মেলা কিন্তু করোনাকালীন কোথাও মেলার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি ফলে তারা অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এখন করোনা চলে গেছে সেক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গায় মেলার ব্যবস্থা করলে তাদের অনেকটা বেচাকেনা বেড়ে যাবে, কুমাররা পুরাতন কাজে ফিরে যাবে।

আরিফুল ইসলাম রনক/আরকে