দালালচক্রের সদস্যরা প্রথমে ইতালিতে উন্নত জীবনযাপনের লোভ দেখায়। নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে আগ্রহী যুবকদের লিবিয়ায় পাঠিয়ে তুলে তাদের দেওয়া হয় সংঘবদ্ধ মাফিয়াদের হাতে। এরপর তাদের নির্যাতনের ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠিয়ে আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা। এমনকি পরিবার মুক্তিপণ দিতে রাজি না হলে অনেককে দিতে হয় জীবন। এমন প্রলোভনের শিকার হয়েছেন মাদারীপুর সদর উপজেলা মস্তোফাপুর ইউনিয়ন দক্ষিণ খাগছাড়া গ্রামে ৯নং ওয়ার্ডের আয়ুব আলী কাজীর ছেলে বসির কাজী (২৮)।

বসিরের বাবা আয়ুব আলী কাজী বলেন, ২০২২ সালের জুন মাসে ছেলেকে লিবিয়া দিয়ে ইতালিতে পাঠানোর জন্য ১০ লাখ টাকায় চুক্তি হয় একই ইউনিয়নের সুচারভাঙ্গা গ্রামের নাদু বেপারীর ছেলে সোহেল দালালের সঙ্গে। পরে আমার ছেলেকে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া নেন। লিবিয়ায় পৌঁছানো পরে আবার গেইম করানোর জন্য চুক্তি হয় ২ লাখ টাকায়। পরে তিনি গেইম বা ভিসা করানোর জন্য একইস্থানে ছয় মাস রেখে মাফিয়া শরীফের কাছে আমার ছেলেসহ বেশ কয়েকজনকে বিক্রি করে দেয়। লিবিয়ার জিমনেসিয়ানে বন্দি রেখে কয়েক মাস পরে ওই দালাল আমাদের কাছে আরও ১১ লাখ টাকা দাবি করেন। না দিলে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেয়। আমার ছেলেকে নির্যাতন করার দৃশ্য মোবাইল ফোনে দেখায়। এরপর আমরা তাকে আমাদের জমি ও বাড়ি বিক্রি করে ১১ লাখ টাকা দিলে এর কয়েকদিন পরে গেইম করায়। গেইমের তিনদিনের মাথায় আবার ধরা খায়। পরে অন্য দালালের মাধ্যমে ৪ লাখ দিয়ে মাফিয়ার থেকে আমার ছেলেকে রক্ষা করি। পরে চেয়রাম্যান নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও স্যারকে দিয়ে লিবিয়া রাষ্ট্রে চিঠির মাধ্যমে আমার ছেলেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে আনতে পেরেছি।

লিবিয়া থেকে ফিরে এসে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বসির কাজী বলেন, গলায় পা দিয়ে মারধর করতো, লাথি মারতো, মাথা ধরে দেয়ালে ঠুকে মারতো, ইলেকট্রিক শক দিত। পানি খেতে চাইলে বাথরুম থেকে বদনায় করে পানি এনে দিত। এইভাবে বিদেশ যাওয়ার চেয়ে বাংলাদেশে অন্যের জমিতে কাজ করে খাওয়া অনেক ভালো। এমন নির্যাতনের  দৃশ্য দেখে বাবা-মা ও আত্মীয় স্বজনরাও আমার জন্য নিঃস্ব হয়ে গেছে। এই সোহেল দালালের কারণে আজকে আমরা নিঃস্ব হয়েছি তাই আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের কাছে  এই সোহেল দালালের সঠিক বিচার ও আমার পাওনা টাকা চাই।

স্থানীয় খোকন মিয়া বলেন, যে একই এলাকার দালাল সোহেল বেপারী ইটালি নেওয়ার কথা বলে বসিরের কাছে থেকে প্রথমে ১০ লাখ টাকা নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে আবার ১০ লাখ টাকা নিয়েছে ।এরকম করে দফায় দফায় ২৮ লাখ টাকা নিয়েছে। এই টাকা যে নির্যাতন করেছে সেই ভিডিও দেখে চোখে পানি ধরে রাখতে পারি নাই। সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি সরকার যেন তার কঠিন বিচার করে।

বসিরের মা রাজিয়া বেগম বলেন, সোহেল আমার ছেলেকে ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় রেখে আমার ছেলেকে টাকার জন্য নির্যাতন করেছে। পাওনাদার  টাকার জন্য আমাদের বাড়িতে প্রতিনিয়ত আসে। টাকা দেওয়ার মতো আমাদের সামর্থ্য নেই। আমাদের তো এখন ভাত খেতে কষ্ট হয়ে যায়। এই সোহেল দালালের বিচার চাই প্রশাসনের কাছে। 

মস্তোফাপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মিন্টু কাজী বলেন, বিষয়টি শুনেছি সরকারিভাবে বসিরকে লিবিয়া থেকে বাংলাদেশে আনা হয়েছে। বিদেশ যাওয়ার বসিরের পরিবার একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাদেরকে অবশ্য সাহায্য করা হবে।

মস্তোফাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন খান বলেন, সরকারিভাবে লিবিয়া থেকেই বসিরকে বাংলাদেশ আনা হয়েছে। বসিরের যে দালাল প্রতারণা করেছে আমার প্রশাসনের অনুরোধ সেই দালালকে আইনের আওতায় এসে কঠোর শাস্তি দাবি জানাচ্ছি। 

সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মাইনউদ্দিন বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনে চেষ্টা অব্যহত আছে। লিবিয়ায় বন্দী অনেককে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বর্তমানে আরও প্রায় দেড় শত লোক লিবিয়ায় বন্দী আছে তাদের ফিরিয়ে আনার সব ধরণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। এছাড়া ফিরে আসা যুবকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে বেকার সমস্যা সমাধান হয়। 

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মো. মাসুদ আলম বলেন, অবৈধ মানবপাচার রোধে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দালালদের বা মাফিয়ার হাতে কেউ আটকা থাকলে বিভিন্ন কারণে আমাদের জানায় না। তারা নিজেরাই আপোষ করে ফেলে। অভিযোগ যতগুলো পাওয়া গেছে তার ওপরে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, এ অঞ্চলে অবৈধ পথে বিদেশ গমনের প্রবণতা অনেক বেশি। অনেকে ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ গমন করতে গিয়ে মারা গেছে। অবৈধ বিদেশ গমন ঠেকাতে আমরা বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।

রাকিব হাসান/আরকে