রঙিন এ পৃথিবী ঘুটঘুটে অন্ধকার। নেই তার দু’চোখে আলো। চোখের আলো না থাকলেও কণ্ঠে আছে যাদু। যে যাদুতে বুঁদ হয়ে থাকে গানপ্রেমি মানুষ। বলছি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চরহাসাদিয়া গ্রামের জুয়েল মিয়ার কথা।

ঝলমলে আলোকোজ্জ্বল জীবনে আঁধার নেমে আসা যেন এক গল্প তার জীবনের। জুয়েলের বয়স যখন তিন কী চার, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন জুয়েল। চিকিৎসা হিসেবে গ্রামের হাতুরি ডাক্তার তার মাথায় ইনজেকশন দেয়। এরপর থেকেই সমস্যা দেখা দেয় চোখে। এক পর্যায়ে মেনে নিতে হয় অন্ধত্বের কঠিন বাস্তবতাকে।

ছেলের অসহায় অন্ধত্ব জীবনের প্রতি মায়া হয়নি দশ মাস গর্ভে ধরা মায়েরও। ছেলে অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মা সংসার ফেলে অন্য জায়গায় চলে যায়। এরপর থেকে নানি, মামা, খালার কাছেই বড় হতে থাকে জুয়েল। বয়স যখন ছয় তখন টাঙ্গাইলের একটা স্কুলে ভর্তি করানো হয় তাকে। সেখানে কয়েক বছর পড়াশোনা করে বাড়ি ফিরে আসে জুয়েল। তখন তার বাবা চোখের চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ২০০৬ সালে বাবা মারা গেলে টাকার অভাবে আর চিকিৎসা করা হয়নি তার।

এরপর অভাবের তাড়নায় টাকা যোগাতে ১৫ বছর বয়সে হাতে তোলে নেন ড্রাম আর দুটি কাঠি। এসব দিয়েই পথে পথে গান গেয়ে বেড়ান জুয়েল। শুনে শুনে মুখস্থ করেছেন শতাধিক গান। লোকসংগীত, বিচ্ছেদী গান গেয়েই দর্শকদের শোনান। খুশি হয়ে তারা যা দেন তাই দিয়েই চলে সংসার।

সম্প্রতি এক বিকেলে ময়মনসিংহ নগরীর রহমতপুর বাইপাস মোড়ে দেখা মেলে জুয়েলের। একটি টং দোকানের পেছনে বসে কাঠি দিয়ে ড্রাম বাজাতে বাজাতে গান ধরেন তিনি। মুহূর্তেই গান শুনতে জড়ো হয় ১০-১৫ জন মানুষ। প্রথম গানটি গাওয়া শেষ করার সাথে সাথে কেউ ২০ টাকা, কেউ ৫০, কেউবা ১০০ টাকার নোট হাতে ধরিয়ে দেয় জুয়েলের। জুয়েল খুশি মনে ফের ধরেন গান।

বিকেল গড়িয়ে নেমে আসে সন্ধ্যা। থামেন জুয়েলও। এসময় তার সঙ্গে বেশ কিছু সময় আলাপ চলে এ প্রতিবেদকের। তার এমন করুণ পরিণতির কথা জানতে চাইতেই দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলতে থাকেন তার কষ্টগাঁথা জীবনের গল্প। কথায় কথায় উঠে আসে জীবনের প্রতিবন্ধকতা এবং সুখ-দুঃখের সাতকাহন। জুয়েলকে হাতড়ে হাতড়ে পথ চলতে হয়। কথা বলার সময় বারবার কেঁপে ওঠে চোখের পাতা।
 
জুয়েল বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর জীবন চালাতে আমি এই পথ বেছে নিয়েছি। আমার পক্ষে তো অন্য কোনো কাজ করে উপার্জন করা সম্ভব নয়। তাই বিভিন্নস্থানে শোনে শোনে মুখস্ত করা গানগুলো গেয়ে বেড়াই পথে প্রান্তরে। মানুষ আমার গান শুনে যা দেয় তাই দিয়েই স্ত্রী আর ছোট দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আমার দিন চলে যাচ্ছে।

জুয়েল বলেন, আমার শতাধিক গান মুখস্থ। আমি নিজেও কিছু গান বেধেছি। সেগুলো সুর করে শ্রোতাদের শোনাই। তবে আমি সাধারণত বিচ্ছেদি শোনাতে পছন্দ করি। হিন্দি গান গাইতে একদম ভালো লাগে না। হিন্দি গান অনেকে শুনতে চান মাঝেমধ্যে কিন্তু আমার ভালো লাগে না।

সব শেষে একটা ইচ্ছার কথাও জানান জুয়েল। তিনি চান, শিল্পকলায় কিংবা সংগীতের প্রতিষ্ঠান থেকে গানের বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে। বলেন, সেই সুযোগ পেলে হয়তো আরও ভালো গাইতে পারতাম। তাহলেও আমার উপার্জন বাড়ত। সংসারে সবাইকে নিয়ে একটু ভালো থাকতে পারতাম। কারণ গানই তো আমার জীবিকা, বেঁচে থাকার উৎস...।

এমএএস