সাভারের আশুলিয়ায় বুড়িরবাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় ৪শ গ্রাহকের তিন কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে একটি চক্রের বিরুদ্ধে। চক্রটি ২০০৯ সাল থেকে এমন প্রতারণা করে আসছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আশুলিয়ার বাইপাইলের উত্তরগাজিরচট এলাকার বুড়িরবাজারের "বুড়িরবাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড" নামের একটি সমবায় সমিতির নবায়ন নেন কেরামত আলী (৫৫)। পরে তিনি বিভিন্নভাবে পোশাক শ্রমিকদের কাছে গিয়ে ডিপিএসের নামে টাকা জমা দিতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তার দেখানো প্রলোভনে পোশাক শ্রমিকরা টাকা জমাও করতে থাকেন। কিন্তু তাদের জমানো টাকা ফেরত চাইতে গেলে তালবাহানা শুরু করেন কেরামত।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কেরামত আলী "বুড়িরবাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড" এর সভাপতি। তিনি জয়পুরহাটের কালাই থানার জগডুমবুর এলাকা থেকে জীবিকার তাগিদে সাভারের আশুলিয়ায় আসেন। পরে তার স্ত্রী রেবেকা খাতুনকে পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়ে দেন ও নিজে ক্রোকারিজের দোকান দিয়ে বসেন। কিন্তু এই আয় দিয়ে মন ভরেনি কেরামতের। সিদ্ধান্ত নেন সমবায় সমিতি গড়ে তুলবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সমবায় সমিতির নবায়ন নিয়ে স্ত্রী রেবেকা খাতুন (৪৫), খানজাহান আলী (৪৫), আবুল কাশেম (৪০), নিহার রায় (৪০), কামরুন্নাহার বেবি (৪২), আজমল (৪৫), সোলাইমান (৪৩) ও মজিবুল্লাহকে (৪৫) নিয়ে শুরু করেন প্রতারণার ব্যবসা।

ভুক্তভোগী সাবিনা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা করে সঞ্চয় করায়। ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আমরা সঞ্চয় করেছি। স্বামী-স্ত্রী দুইজন মিলে গার্মেন্টসে কাজ করে খরচ বাদে যাবতীয় টাকা সেখানে জমা করেছি। আমাদের প্রায় ৫ বছরের রক্ত পানি করা টাকা সেখানে আমানত রেখেছি। কিন্তু সেই টাকা চাইতে গেলে, টাকা না দিয়ে তালবাহানা করছে। কেরামত টাকা না দিয়ে প্রায় ৮ মাস ধরে আমাকে ঘোরাচ্ছে। আমি সরকারি ঘরে থাকি। কেরামতকে গিয়ে অনেক অনুরোধ করেছি যে টাকাগুলো দেন আমি ঘর নির্মাণ করব। তার কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করেছি। কিন্তু সে কোনো টাকা দেয়নি। উল্টো হুমকি-ধামকি দিয়েছেন। সাবিনার হিসাবে ৫ লাখ ২৪ হাজার টাকা ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা রয়েছে।

এছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানে পোশাক শ্রমিক মোকসেদুল ১ লাখ ৩৫ হাজার, নাজমা খাতুন ১ লাখ ২০ হাজার, শফিকুল মিয়া ৩৯ হাজার, রাজু শেখ ৩৮ হাজার ২০০, নুরুন্নাহার ৫৯ হাজার, বিকাশ চাকমা ৩ লাখ ২৮ হাজার, কলিনা চাকমা ২ লাখ ৬৭ হাজার,  ফিরোজ ১০ হাজার, নুরজাহান ২ লাখ ৯৯ হাজার ৫০০, সুজিত চন্দ্র ১ লাখ ২৪ হাজার ৫০০ ডিপোজিট করেছেন। 

এছাড়া আরও প্রায় ৪০০ জন গ্রাহকের প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা সঞ্চয়ের নামে সংগ্রহ করে আত্মসাৎ করেছে চক্রটি।

ভুক্তভোগী শ্রমিক নুরজাহান বলেন, আমাদের সারাজীবনের সঞ্চয় ওই সমিতিতে জমা করেছিলাম। প্রায় ৭ বছরের পরিশ্রম আমাদের শেষ করে দিয়েছি। এখানে এমন লোকও আছে গ্রাম থেকে জমি বিক্রি করে ডিপোজিট করেছে বেশি লাভের আশায়। আমরা এই প্রতারক চক্রের বিচার চাই ও আমাদের টাকা ফেরত চাই। এমন গ্রাহকও আছে যদি খবর পান প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন তাহলে অসুস্থ হয়ে পরবেন। কারণ গার্মেন্টসে কাজ করে খেয়ে না খেয়ে টাকা জমিয়েছেন। সব গ্রাহকেরই ডিপোজিটের নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেছে। তবে বছর অতিবাহিত হলেও ডিপিএসের টাকা ফেরত দিচ্ছে না। 

ভুক্তভোগী কলিনা চাকমা বলেন, তারা অফিস অনিয়মিত করছেন। যথাযথভাবে অফিস পরিচালনা করছেন না। যারা কর্মী ছিলেন সকলকে বিদায় করে দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কোনো কর্মী নেই। মানে তারা পালানোর সুযোগ খুঁজছেন।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত কেরামত আলী বলেন, আমরা ২০০৯ সালে এই প্রতিষ্ঠান দিয়েছি। এতোদিন সুনামের সঙ্গে পরিচালনা করেছি। কিন্তু করোনার সময় আমাদের অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায়। এছাড়া আশপাশের বেশ কিছু সমিতি পালিয়ে যাওয়ায় সকল গ্রাহক একসঙ্গে টাকা চাইছেন। সকল গ্রাহককে তো একবারে টাকা প্রদান করা সম্ভব নয়।

নির্ধারিত সময় শেষ হলেও গ্রাহক টাকা পাচ্ছে না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এক গ্রাহককে ১ লাখ টাকা দিয়েছি। বাকি টাকা ৮ মাস পরে দেওয়ার জন্য সময় চেয়েছি। সমিতির মালিকপক্ষের অন্য সদস্যদের অনেক খোঁজাখুঁজি করেও দেখা পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে সাভার সমবায় কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, এ ধরনের সমিতিতে কোনোভাবেই ডিপোজিট নেওয়ার নিয়ম নেই। যদি কেউ ডিপোজিট সংগ্রহ করেন। তাহলে বেআইনিভাবে সংগ্রহ করেছেন। এমন তথ্য পেলে সমিতির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একই সঙ্গে লাইসেন্স বাতিল করা হবে।

সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই কাম্য নয়। খবর নিয়ে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করব। তবে সবাইকে সচেতন হতে হবে কোনো অবস্থাতেই এসব প্রতিষ্ঠানে ডিপোজিট করা যাবে না। ডিপোজিট ব্যাংকে করলে টাকা খোয়ানোর সুযোগ নেই।

মাহিদুল মাহিদ/আরকে