একটি সড়ক দুর্ঘটনা মোকলেস শিকাদারের (৫২) পরিবারে বয়ে এনেছে সারাজীবনের কান্না। পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মোকলেস সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করায় তার পরিবারে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ।  

তিনি মাদারীপুর কালকিনি উপজেলার বাশগাড়ি ইউনিয়নের কানুরগাও গ্রামের আলী আহম্মদ শিকদারের ছেলে। মোকলেস শিকদারের স্ত্রী খুরশিদা বেগম। বড় মেয়ে শিউলি আক্তার (১৭), ছেলে রাকিব শিকদার (১৬) ও রাজিব শিকদারসহ (১২) তাদের তিন সন্তান।

পারিবারিক সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৫ সালে অক্টোবর মাসের শেষের দিকে এক দিন সকালে মোকলেস শিকদার নিজ বাড়ি থেকে শিবচর উপজেলার শেখপুর বাজারে পাটখড়ি কেনার জন্য বের হন। শিবচর থেকে পাটখড়ি কিনে এনে তা কালকিনি উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি করতেন তিনি। কেনা পাটখড়ি আনার জন্য তিনি ভাড়া করেছিলেন একটি নছিমন। কিন্তু সেখান থেকে কালকিনির লক্ষ্মীপুরের দিকে এলে নছিমনটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। নছিমনটি মোকলেসের গায়ের ওপরে পড়ে। এই দুর্ঘটনায় মোকলেস শিকদারের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। অনেক চিকিৎসার পরও কোনো লাভ হয়নি। চিরতরে পঙ্গু হতে হয়েছে তাকে। বিছানা থেকে উঠতে পারেন না তিনি। এখন স্ত্রী বা ছেলেমেয়ের সহযোগিতা ছাড়া একটু নড়ার ক্ষমতা নেই তার। গত বছর মাদারীপুরের সাবেক পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল তাকে একটি হুইল চেয়ার দেন। সেই চেয়ারটি পেয়ে কিছুটা হলেও তার স্বস্তি মেলে। 

মোকলেস ও খুরশিদার স্বপ্ন ছিল তাদের সন্তানেরা পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরি করবে। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। দুই ভাইকে টাকার অভাবে সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। বর্তমানে বড় ছেলের পাশাপাশি ছোট ছেলেও লেখাপড়া বাদ দিয়ে কাজে যাচ্ছে। 

পঙ্গু মোকলেস শিকদারের স্ত্রী খুরশিদা বেগম বলেন, আমার স্বামী পাটখড়ির কেনাবেচার ব্যবসা করত। আমাদের সংসার ভালোই চলছিল। আট নয় বছর আগে নছিমন গাড়ি উল্টে গিয়ে আমার স্বামীর মেরুদন্ড ভেঙে পঙ্গু হয়ে যান। পরে ঘরবাড়ি জমিজমা বিক্রি করে তাকে চিকিৎসা করিয়েছি। ডাক্তার বলছে সে যেভাবে আছে এইভাবে থাকবে, তবে উন্নতি চিকিৎসা করানো গেলে ভালোও হতে পারে।  টাকা-পয়সা দিয়ে তাকে চিকিৎসা করে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছি আমরা। এখন উন্নত চিকিৎসা করার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। 

তিনি আরও বলেন, টাকার অভাবে কয়েক মাস হলো ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা বন্ধ করতে হয়েছে। এদিকে সন্তানদের খাওয়াব না ওর বাপের চিকিৎসার ওষুধ কিনব। সব কিছুই ধারদেনা করে চলছে। এজন্য দুই ছেলেকে একটি হোটেলে কাজ করতে দিয়েছি। সেখান থেকে যে টাকা আসে তা দিয়ে সংসার চলে। এই টাকায় ওষুধ কিনতে হয়, লোনের জন্য কিস্তির টাকা দিতে হয়। তাছাড়া মেয়েটাও বড় হয়ে গেছে। কীভাবে বিয়ে দেব জানি না। 

পঙ্গু মোকলেস শিকদার বলেন, বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠের মধ্যে বড় বড় ঘা হয়েছে। এমনিতে টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে পারি না। তাছাড়া আমার বসত ঘরটির এমন অবস্থা হয়েছিল যে বসবাস করার মতো ছিল না। তাই গত বছরে এনজিও থেকে লোন করে ছোট একটি টিনের ঘর দেই। সেই কিস্তির টাকাও ঠিকমতো দিতে পারছি না। বর্তমানে ৮০ হাজার টাকার লোন নেওয়া আছে।  অনেক কষ্ট হয় কিস্তির টাকা দিতে। আমার দুটি ছোট ছোট ছেলেকে পড়াশোনা বাদ দিয়ে হোটেলে কাজ করতে হচ্ছে। আমি বাবা হয়ে সব দেখছি, কিন্তু কিছুই করতে পারছি না। এটা আমার জন্য খুবই কষ্টকর। 

পঙ্গু মোকলেসের ছেলে রাকিব সিকদার বলেন, আমি আগে স্কুলে যাইতাম লেখাপড়া করতাম। আজকে আমার আব্বার এই অবস্থা হওয়ার কারণে আমি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে হোটেলে কাজ করে ওষুধ এবং ঘরের চাল কিন্না সংসার চালাই। আমাদের অনেক কষ্ট হয়। আপনারা আমাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করলে আমার আব্বাকে সুস্থ করতে পারব। 

 প্রতিবেশী মজিবর খা জানান, মোকলেস শিকদারের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। আমরা এলাকাবাসী কিছু কিছু টাকা উঠাইয়া দিয়েছি তার চিকিৎসার জন্য। দুর্ঘটনার পর থেকে পারিবারটি অসহায় হয়ে পড়েছে। তার একটি বড় মেয়ে আসে টাকার অভাবে সে মেয়েটিও বিয়ে দিতে পারছে না।

বাঁশগাড়ি ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান সুমন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিবন্ধী মোকলেসকে আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাকে সাহায্য সহযোগিতা করা হবে।

মাদারীপুরের আছমত আলী খান সেন্ট্রার হাসপাতালের চিকিৎসক মোহাম্মদ সোহেলউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পঙ্গু মোকলেস শিকদারের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। পিঠের মধ্যে অনেক বড় বড় ঘা হয়েছিল। কিন্তু টাকার অভাবে তিনি ডাক্তার দেখাতে পারেননি। আমি জানতে পেরে তাকে দেখে চিকিৎসক দেখিয়ে ওষুধ কিনে দিয়েছিলাম। আমরা সকলে এগিয়ে আসলে অসহায় লোকটি পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। 

কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পিংকি সাহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিবন্ধী মোকলেসের পরিবার আমাদের কাছে আবেদন করলে আমরা সমাজ সেবা অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা মাধ্যমে তাকে সাহায্য করতে পারব। 

রাকিব হাসান/আরকে