ফাইল ছবি

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়ির চার পুলিশ সদস্যকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার ১০ বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হলে সুন্দরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অগ্নিকাণ্ড-লুটপাট আর তাণ্ডব চালায় জামায়াত শিবিরের সশস্ত্র সদস্যরা।

তারা বামনডাঙ্গা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের চার পুলিশ সদস্যকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। এসময় জিহ্বা কেটে, চোখ উপড়ে হত্যা করা হয় গংশারহাটের এক আওয়ামী লীগ সমর্থককে। 

তবে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাযজ্ঞের ১০ বছরেও গতি নেই বিচার কার্যে। মামলার ৭৪ জন সাক্ষীর মধ্যে গত ৯ বছরে সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে মাত্র ২৬ জনের। আগামী ১২ মার্চ মামলার পরবর্তী দিন ধার্য করেছে আদালত।

আদালত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসামি মৃত্যু, মহামারি করোনা ও আদালতে বিচারক না থাকায় বিচারে কিছুটা ধীর গতি হয়েছে। তবে খুব দ্রুত সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করে চাঞ্চল্যকর এই মামলার বিচারকাজ শেষ হবে বলে প্রত্যাশা তাদের।

মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর রায়ের দিনে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে হরতালের ডাক দেয় জামায়াত-শিবির। হরতালের সমর্থকরা এদিন সকাল থেকেই সুন্দরগঞ্জের সর্বানন্দ, রামজীবন, ধোপাডাঙ্গা, কঞ্চিবাড়ী, বেলকা, দহবন্দ, হরিপুর ও বামনডাঙ্গা ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ-মিছিল করে হরতাল পালন করে। হরতাল পালনের নামে তারা শোভাগঞ্জ, ছাত্যানতলা ও বামনডাঙ্গা বাজার, বীর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়, আওয়ামী লীগের কার্যালয়, বামনডাঙ্গা রেলস্টেশন, রেলের প্রকৌশল অফিসসহ স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর-লুটপাট চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। উপড়ে ফেলা হয় বামনডাঙ্গা রেলস্টেশনের লাইন।

এদিন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পরপরই বিকেল সোয়া ৪টার দিকে হরতালকারীরা বামনডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালায়। হামলার সময় পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দুই পুলিশ সদস্য নিহত হন। এছাড়া গুরুতর আহত অপর দুইজনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তাদেরও মৃত্যু হয়। শুধু তাই নয় গংশারহাটের এক আওয়ামী লীগ সমর্থক এসব ঘটনার প্রতিবাদ করলে তার জিহ্বা কেটে, চোখ উপড়ে ফেলে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার ধারাবাহিকতায় হত্যা করা হয় আরো তিনজনকে।

বামনডাঙ্গা রেল লাইনে আগুন ধরিয়ে দেয় হরতালকারীরা 

পরে চাঞ্চল্যকর জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যার ঘটনায় ৯২ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত আরো পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার জনের বিরুদ্ধে সুন্দরগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবু হানিফ। পরে দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর একজন শিশুসহ ২৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে গাইবান্ধা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেয় পুলিশ।

এদিকে এমন বর্বরোচিত ও লোমহর্ষক ঘটনার ৯ বছর পার হলেও সেই ভয়াবহ স্মৃতি ও স্বজন হারানোর বেদনা আজও ভুলতে পারেননি অনেকেই। আতঙ্ক কাটেনি প্রত্যক্ষ তাণ্ডব দেখা মানুষগুলোর। আজও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত মামলার সাক্ষীরা। এছাড়া আলোচিত এই মামলার নয় বছরেও জড়িতদের বিচার না হওয়ায় হতাশ নিহতের স্বজন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা। দ্রুত মামলার বিচার শেষ করে অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি গাইবান্ধাবাসীর।

গাইবান্ধার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফারুক আহম্মেদ প্রিন্স ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলার ৭৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ইতোমধ্যে ২৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। এই মামলার আটজন আসামি মারা গেছেন। ঘটনার পর থেকেই এ মামলার প্রধান আসামি সুন্দরগঞ্জ আসনের সাবেক এমপি ও ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আব্দুল আজিজ ওরফে ঘোড়ামারা আজিজসহ পলাতক রয়েছেন ছয়জন। জামিনে পলাতক রয়েছে দুইজন। তাছাড়া বাকি ২১৯ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও তারা সকলেই বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। 

তিনি আরও বলেন, আসামিদের মৃত্যু, দেশে মহামারি করোনা আর আদালতে বিচারক না থাকায় বিচারিক কার্যক্রমে কিছুটা ধীর গতি হয়েছে। আগামী ১২ মার্চ মামলার পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে। আশা করি দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা হবে।

অন্যদিকে ঘটনার পর থেকেই প্রতিবছর এই দিনটিতে বামনডাঙ্গা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে পুলিশ সদস্য তোজাম্মেল হক, নাজিম উদ্দিন, বাবলু মিয়া ও হজরত আলী স্মরণে চার পুলিশের বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সুন্দরগঞ্জের পুলিশেরা। আজ মঙ্গলবার সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আবদুল আলিম মাহমুদ ও গাইবান্ধার পুলিশ সুপার কামাল হোসেনসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা। এসব বিষয় নিশ্চিত করেন সুন্দরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সরকার ইফতেখারুল মোকাদ্দেম।

রিপন আকন্দ/আরকে