বিমায় নাকি অনেক সুযোগ-সুবিধা। বিমা সম্পর্কে আমাকে কতবার যে বুঝিয়েছিল তার হিসাব আমার মনে নেই। অসুস্থ হলে নাকি টাকা দেবে। যে কোনো বিপদে আপদে পাশে থাকবে। মরে গেলে এর কয়েকগুন বেশি টাকা দেবে। তাদের কথা অনুযায়ী আর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পলিসি করেছি। অথচ এখন ঘুরতে ঘুরতে আমি হয়রান। লাভের টাকা তো দূরের কথা আসল টাকায় পাই না। মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই বছর পার হয়েছে। প্রতিমাসে তিন চারবার করে আসি। তাও কোনো খবর নাই। আজ কাল করতে করতে দিন শেষ হয় যায়। এভাবে আর কতদিন ঘুরতে হবে, আমি কি আমার টাকাটা পাব না? 

বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) দুপুরে ঠাকুরগাঁওয়ের প্রগেসিভ লাইফ ইন্সুরেন্স অফিসের সামনে এভাবেই ঢাকা পোস্টকে বলছিলেন সদর উপজেলার ২৮ মাইল থেকে আসা ভুক্তভোগী রহিতুন নেছা (৫২)। 

তিনি বলেন, ২০০৯ সালে প্রগেসিভ লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে ১২ বছর মেয়াদি বিমা করি। যার পলিসি নাম্বার ০৬০৯০৭২-৭।  সেটার মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই বছর পার হয়ে যাচ্ছে অথচ এখনও টাকা পাচ্ছি না। আজ হবে, কাল হবে বলতে বলতে বছর চলে যায়, তাও সময় শেষ হয় না। 

এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে তাদের অফিসে গেলে উল্টো তারা আমার সঙ্গে উগ্র আচরণ করে। এক বছর আগে বলল নতুন অ্যাকাউন্ট করলেই টাকাটা পাবেন। আমি সুদের ওপর ২৫০০ টাকা নিয়ে নতুন অ্যাকাউন্টে জমা দিয়েছি, কিন্তু এখনও টাকা পাইনি। তাদের অফিসে এলেও তারা গুরুত্ব দেন না। আজকেও এলাম, তারা বলল আগামী মাসে আসতে। ম্যানেজার শুধু মোবাইলে কথা বলে। উনাকে সরাসরি দেখা যায় না। 

রহিতুন নেছার মতোই অভিযোগ তুললেন তার সঙ্গে আসা তাহেরা বেগম। তিনিও প্রগেসিভ লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে বিমা করেছেন। তিনি বলেন, মেয়াদ শেষে যে টাকা পাব সেটার কোনো খবর নেই। তাদের অফিসে এলে বারবার বলে ঢাকা থেকে না হলে আমরা কী করবো। আমরা যখন বিমা শুরু করি তখনকার সময় ১০০ টাকা এখনকার ১০০০০ টাকার মতো। তারা আমার কোনো কথায় শোনেন না। কিছুদিন আগে বলল ২ তারিখে আসেন, আজকে বললো ৫ তারিখে আসেন। এভাবেই তারিখ পরিবর্তন হতে থাকে। অনেকজনকে বলেছি আমার টাকা উঠানোর জন্য, কিন্তু এখনও পাচ্ছি না। 

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য প্রগেসিভ লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির ঠাকুরগাঁও অফিসে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, এক কম্পিউটারে টেবিলে একজন কাজ করছেন। তার পাশে রয়েছেন একজন পিয়ন। দুজনে মিলে পরিচালনা করছেন জেলা কার্যালয় অফিস।  ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি নাকি সপ্তাহে দুদিন অফিস করেন। সেই দুদিন কবে সেটার সঠিক উত্তর দিতে পারেননি পিয়ন। 

অফিস থেকে বের হওয়ার সময় দেখা মিলে আমিনুল ইসলাম নামে এক যুবকের। তার বাবার পলিসির মেয়াদ তিন বছর আগে শেষ হয়েছে। অফিসে কয়েকবার এসে হয়রানি হওয়ার অভিযোগ করলেন আমিনুল।

তিনি বলেন, আমার বাবা এখানে বিমা করেছিলেন। বিমার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ৩০ বারের বেশি আসা যাওয়া করছি এই অফিসে। আমার মতো ভুক্তভোগী অনেকেই আমাদের গ্রামে আছেন। এখানে আসা-যাওয়া করতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়েছে তাতে মনে হয় বিমার টাকাটা ছেড়ে দেওয়াই ভালো ছিল। এখানে আসলে বলে কাজ হয়ে যাবে। ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা হয়ছিল একদিন। উনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম স্যার এতো ভোগান্তি কেন, এতো কেন ঘুরতে হয়। সেদিন তিনি আমার ওপর গরম হয়ে গেছিলেন। অনেক কষ্ট করে আমার বাবা এ টাকাটা জমিয়েছে। 

সরাসরি কয়েকদিন অফিসে গিয়েও দেখা না হওয়ায় মুঠোফোনে কথা হয়েছে প্রগেসিভ লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ম্যানেজার আলিমুল ইসলামের সঙ্গে। গ্রাহকদের ভোগান্তি ও এখনও ৫০০-৬০০ গ্রাহককে মেয়াদ পূর্তির পরও টাকা না দিতে পারার কথা স্বীকার করে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সবাই মনে করেন আমরা এখান থেকে তাদের টাকা ফেরত দিচ্ছি না। এটা আসলে সত্য না। মূলত ঢাকা থেকে দেরি করার কারণে আমাদেরও দেরি করতে হচ্ছে। বিমা গ্রাহকদের ঘুরাতে হয়। গত বছর অনেকজনকে পলিসির টাকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে বাকিদেরও টাকা দিয়ে দেওয়া হবে।  

এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি দুঃখজনক বিষয়। আমরা বিমা কোম্পানিগুলোকে এ বিষয়ে জোরালো তাগিদ দিয়েছি। তারপরও কেউ যদি এ বিষয়ে অভিযোগ করে তাহলে আমরা পদক্ষেপ নেব।

এম এ সামাদ/এমএএস