নয় বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ায় জীবিকার জন্য কাজের সন্ধানে চট্রগ্রামে যান সিরাজ উদ্দীন (৪২)। ৭০০ টাকায় মাসিক বেতনের চাকরিতে তার চালাতে হতো ৫ জনের সংসার। দিন দিন সংসারের খরচ বাড়লেও আয় বাড়েনি সিরাজের। বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামের বাড়ি ফিরে জমি বর্গা নিয়ে চাষ শুরু করেন তিনি। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি সিরাজকে। বর্তমানে তার চাষ করা সবজি যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে।

সিরাজ উদ্দিন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের চরলক্ষ্মী গ্রামের মৃত শাহজাহানের ছেলে। বর্তমানে তিনি চার একর জমিতে শাক সবজি উৎপাদন করছেন। গতবছর মধ্যেপ্রাচ্যে লাউ রপ্তানি করেছিলেন তিনি। এবছর তার চাষ করা সবজি মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে রপ্তানি হচ্ছে। তাকে দেখে এ এলাকার লোকজন সবজি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। বর্তমানে মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন থেকে সবচেয়ে বেশি সবজি রপ্তানি হয়ে থাকে।

সিরাজ উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর মাত্র ৭০০ টাকা বেতনের চাকরি করেছি। যখন চাকরি করেছি রাতে না খেয়ে থেকেছি। সেই চাকরি ছেড়ে গত ৩ বছর ধরে আমি সবজি ব্যবসা করছি। এখন আমার চাষ করা সবজি বিদেশ যায়। লাউ, করলা, শিম আর কাঁচা মরিচ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে পাঠাচ্ছি।

সিরাজ উদ্দীন

তিনি আরও বলেন, নোয়াখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চল সুবর্ণচরের চরলক্ষ্মী গ্রাম থেকে সারাবিশ্বে সবজি যাচ্ছে। অনেক কৃষক লাভবান হচ্ছেন। নতুন করে সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। এই সপ্তাহে ৮০০ কেজি শিমের বিচি বিদেশে যাবে। কিন্তু আমাদের কোনো সরকারি লাইসেন্স নেই। যদি আমাদের লাইসেন্স করে দেওয়া যেত তাহলে অনেক ভালো হতো।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২৩ অর্থবছরে সুবর্ণচর উপজেলা জুড়ে মোট ৩ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করেছেন কৃষকরা। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে এসব এলাকার সবজি। সবজি চাষে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সহযোগিতা করছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নানান রকমের সবজি চাষ করেছেন মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের কৃষকরা। বিশাল ঘেরের চারপাশে সবজি এবং ভেতরে মাছ চাষ করেছেন তারা। জৈব পদ্ধতির নিরাপদ সবজি হওয়ায় রপ্তানির ফলে মিলছে ভালো দাম। সম্প্রসারিত হচ্ছে নিরাপদ খাদ্যের বাজার। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এবার ইউরোপের বাজার ধরতে প্রস্তুত হচ্ছে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের কৃষকরা। সারা বছর সবজি চাষের মাধ্যমে এক ফসলী জমিকে পরিণত করেছেন তিন ফসলী জমিতে, পেয়েছেন সফলতা।

৩০০ ফুট জায়গায় লাউ চাষ করেছেন কৃষক নুরুদ্দিন (৪০)। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, লাউ চাষ খরচ কম, লাভ বেশি। ৩০০ ফুট জায়গায় প্রচুর লাউ হয়েছে। প্রতি ৩ দিন অন্তর অন্তর এক দেড়শ পিস লাউ বিক্রি করি। কোনো ওষুধ দেওয়া লাগে না। হলুদ কার্ড ব্যবহার করি যার ফলে পোকামাকড় আসতে পারে না। আমাদের লাউ বিদেশে যায়।

১০ হাজার টাকা খরচে ৪ শতাংশ জমিতে কাঁচা মরিচ রোপণ করে ৭০ হাজার টাকার মরিচ বিক্রি করেছেন কৃষক আবুল কালাম (৪০)। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন,  ৪ শতাংশ জমিতে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ করে এক সিজনে বিক্রি করছি ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার মরিচ। এক সময় আমরা ভালো দাম পেতাম না। বিদেশে চালান হয় দেখে আমাদের ভাগ্য বদলে গেছে।

টমেটো চাষি কৃষক মো. সোলেমান (৫০) ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগেও আমরা কৃষি কাজ করতাম কিন্তু দাম পেতাম না। টমেটো বিক্রি হতো ৫-৬ টাকায়। এখন বিভিন্নস্থান থেকে বেপারি আসে এছাড়া দুবাইয়ে বিক্রি হয় তাই ভালো দাম পাই। ৮৫ টাকা পর্যন্ত কেজি বিক্রি করেছি। এখন উৎপাদন বেশি হওয়ায় ২৫ টাকা দাম পাচ্ছি।

বিদেশে যাচ্ছে হরানী বেগমের (৩৫) শিমের বিচি। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছইয়ের (শিম) থেকে এর গোটার (বিচি) দাম বেশি। ছইয়ের (শিম) গোটার (বিচি) বিদেশে যায়। ছই (শিম) দুই লাখ টাকা বিক্রি করেছি, গোটাও (বিচি) ৩-৪ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারব।

তবে এখানকার সড়কের বেহাল দশার ফলে এখানকার কৃষি পণ্য পরিবহনে ভোগান্তি পোহাতে হয় চালকদের। চালক মো. মাসুদ (৩৮) ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদেশে রপ্তানি হওয়ায় আমাদের আয় বেড়ে গেছে। আগে ৫০০ টাকা রোজগার হলে এখন হয় এক হাজার টাকা। রাস্তার কারণে মালামাল আনা নেওয়া করতে অসুবিধা হয়। অনেক সময় কৃষি পণ্যের ক্ষতি হয়। তাই সড়ক দ্রুত সংস্কার করলে সবার জন্য ভালো হতো।

মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সহযোগিতায় আমাদের ইউনিয়নে কৃষির আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু সুবর্ণচরে নয় পুরো নোয়াখালীতে সব থেকে বেশি কৃষি পণ্য উৎপাদন হয় মোহাম্মদপুরে। আগামীতেও কৃষি অফিস এমন সুযোগ সুবিধা ও পরামর্শ অব্যাহত রাখলে আমাদের কৃষকরা লাভবান হবে।
 
সুবর্ণচর উপজেলার কৃষি কর্মকতা মো. হারুন অর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে সুবর্ণচরের সবজি রপ্তানি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আমরা লাউ রপ্তানি করেছি। এ বছর লাউসহ ফুলকপি, বাধাকপি, শিম, শিমের বিচি, টমেটো, কাচা মরিচ রপ্তানি করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কৃষকরা যেন এই রপ্তানিতে অংশ নিতে পারে সেই জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সর্বদা কৃষকের পাশে আছে। জৈব প্রযুক্তির সবজি ছাড়া বিদেশে রপ্তানি করা যায় না। নিরাপদ সবজির বাজার তৈরি করতে পারলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। তাই কৃষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কৃষক লাভবান হলে দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল থাকবে এবং  প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন হবে।

হাসিব আল আমিন/আরকে