‘অ্যার আগে আসছিলাম সখুন (তখন) ১২০ টাকা কেজি ছিল। এখন দাম বার্তি (বৃদ্ধি) ২২০ টাকা। ডাবল হ্যায়ে (হয়ে) গ্যাছে। অ্যার মাসখানেক (এক মাস) আগে অ্যাসছিলাম। মুরগির দাম বার্তির কারণে দুই কেজি মুরগি ২৪০ ট্যাকা দাম ল্যাগত। কিন্তু সেই মুরগি সাড়ে ৪০০ ট্যাকা দাম লাগিচ্ছে । এইভাবে মুরগি নেওয়া যাবে না তো, আমরা মুরগি নিতে পারব না। এত দাম দিয়ে আমরা খাব কী, আমরা গরিব মানুষ। মুরগি কিনতে যে ট্যাকাডা নিয়ে অ্যাসেছিলাম সেই ট্যাকাতে আর মুরগি হ্যাচ্ছে  না। সেই কারণে আমাকে বাকি নিতে হ্যাচ্ছে। বাকি ১৩০ টাকা। যেখানে আমার মুরগি হ্যায়ে যেতো।’

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহীর পবা উপজেলার খড়খড়ি বাজারে মুরগি কিনতে আসা জাহিদ হাসান টিপু নামে এক কাঁচামাল ব্যবসায়ী। তিনি খড়খড়ি বাইপাস এলাকার লোকমানের ছেলে। তার পরিবারে পাঁচ সদস্য। বাবা লোকমান আলীর বয়স বেড়ে যাওয়ায় সংসারের ভার পড়েছে তার ওপরে।

জাহিদ হাসান টিপু জানান, দেড় কেজি ওজনের ব্রয়লার মুরগি কিনেছেন তিনি। দাম পড়েছে ৩৩০ টাকা। দোকানদারকে ২০০ টাকা দিয়েছেন। বাকি রেখেছেন ১৩০ টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্রয়লার মুরগি, মুরগির খাবার (ফিড) ও বাচ্চার দাম বেড়েছে। মুরগির বাচ্চার তুলনায় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাবারের দাম। খাবারের দাম বাড়ায় বেড়েছে মুরগির দাম। তবে মুরগির দাম কম-বেশি হয়। কিন্তু একবার বেড়ে যাওয়া খাবারের দাম আর কমে না। এমন অবস্থায় ব্রয়লার মুরগি খামারে লালন-পালন করে বিক্রিতে তেমন মুনাফা থাকে না খামারিদের। খামারে ৩৫ থেকে ৪০ দিন মুরগি লালন-পালন শেষে বিক্রির পর ফিডের দোকানের ঋণ পরিশোধে টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে খামারিদের।

খামারি ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এক সময় এই ব্রয়ালার মুরগির দাম নির্ধারণ ও বিক্রির এখতিয়ার ছিল খামারিদের হাতে। তখন মুরগি কম দামে বিক্রি হয়েছে। এতে ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের লাভ হয়েছে। কিন্তু এখন মুরগির বাজারটাই সিন্ডিকেটের দখলে চলে গেছে। সব খামার বিভিন্ন কোম্পানির দখলে। কোম্পানিগুলো মুরগির দাম ও ফিডের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। খাবারের দাম যে গতিতে বাড়ে, সেই গতিতে মুরগির দাম বাড়ে না। ফলে সাধারণ খামারিরা ব্রয়লার লালন-পালন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সেই সুযোগে কোম্পানিগুলো বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে খামারগুলো তাদের দখলে নিয়েছে। কোম্পানিগুলো খামারে মুরগির খাবার, ওষুধ, চিকিৎসকের পরামর্শ দিয়ে মুরগি উৎপাদন করছে। আবার তারাই মুরগি বিক্রি করছে। এখানে খামারি মুরগি লালন-পালন বাবদ চুক্তি অনুযায়ী কিছু টাকা পাচ্ছে।

খামারি ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এক সময় এই ব্রয়ালার মুরগির দাম নির্ধারণ ও বিক্রির এখতিয়ার ছিল খামারিদের হাতে। তখন মুরগি কম দামে বিক্রি হয়েছে। এতে ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের লাভ হয়েছে। কিন্তু এখন মুরগির বাজারটাই সিন্ডিকেটের দখলে চলে গেছে। সব খামার বিভিন্ন কোম্পানির দখলে। কোম্পানিগুলো মুরগির দাম ও ফিডের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। খাবারের দাম যে গতিতে বাড়ে, সেই গতিতে মুরগির দাম বাড়ে না। ফলে সাধারণ খামারিরা ব্রয়লার লালন-পালন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সেই সুযোগে কোম্পানিগুলো বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে খামারগুলো তাদের দখলে নিয়েছে

খড়খড়ি এলাকার রিকশাচালক নূর ইসলাম। তার ছয় ছেলে-মেয়ে। তবে দুই ছেলে ও এক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন বাড়িতে এক ছেলে ও দুই মেয়ে আর স্বামী-স্ত্রী মিলে তাদের পাঁচজনের সংসার।

তিনি বলেন, গরুর গোস্ত মেলা দিন থেকে খাইনি। ব্রয়লার মুরগির দাম কম ছিল। এখন ২২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। রিকশা চালিয়ে আর কত টাকা ইনকাম হয়। ভাড়া রিকশার জন্য সাড়ে ৩০০ টাকা দিতে হয় মালিককে। এই টাকা বাদে নিজের সংসারের চাল-ডাল কিনতে হয়। শুধু পানি বাদে সব কিছু কিনতে হয়। আগে ব্রয়লার মুরগি খেতাম। এখন কীভাবে খাব, এত টাকা দামে।

খড়খড়ি বাইপাস বাজারে খুচরা মুরগি ব্যবসায়ী এনামুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন ১৯৫ টাকা প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি কিনতে হচ্ছে। বিক্রি করতে হচ্ছে ২২০ টাকা প্রতি কেজি। মুরগির দাম বাড়ায় কমেছে বিক্রি। এখন প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০টি মুরগি বিক্রি হচ্ছে। যখন দাম কম ছিল তখন প্রতি দিন  ১০০ থেকে ১২০টি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে। ব্রয়লার মুরগির ব্যবসাটা এখন কোম্পানির হাতে। তারা চাইলে দাম কমে, আবার দাম বাড়ে। এখন পুরো সিন্ডিকেট। সব কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। কোম্পানিগুলো থেকে বাচ্চা কিনে দেওয়া হচ্ছে এক শ্রেণির খামারিদের। একই সঙ্গে ডাক্তার ফিড কোম্পানিগুলো থেকে সরবারহ করা হচ্ছে। তাই এই ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে চলে গেছে। মুরগির ব্যবসা আর সাধারণ ব্যবসায়ীদের হাতে নেই। যখন খামারিরা বেশি মুরগি বাজারে তোলেন, তখন কোম্পানিগুলো কৌশলে মুরগির দাম কমিয়ে দেন। এতে করে খামারিরা লোকসানে পড়েন।

তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো রাতারাতি দাম বাড়িয়ে দেয়। তারা এক রাতে ১৫ থেকে ২০ টাকা প্রতি কেজিতে দাম বাড়িয়ে দেয়। কিছু দিন আগে ব্রয়লার মুরগি কিনলাম ১৪৫ টাকা। রাতে ফোন দিয়ে বলে ১৬৫ টাকা। তারা কেজিতে ২৫ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। কেজিতে দুই-একটা বাড়লে সমস্যা হয় না। দাম বাড়ায় ব্যবসার ওপরে ও ক্রেতাদের ওপরে প্রভাব পড়েছে। দাম বেশির কারণে ক্রেতাদের সঙ্গে মাঝে মধ্যেই বাগবিতন্ডায় জড়াতে হচ্ছে আমাদের মতো খুচরা ব্যবসায়ীদের।

ব্রয়লারের খামারি আরিফুল ইসলাম শাহিন বলেন, খাবারের দাম বেশি। ব্রয়লার মুরগি খামারে লালন-পালন করা কষ্টকর হয়ে গেছে। আগে বছরে বেশ কয়েক বার ব্রয়লার মুরগির চালান খামার থেকে বের করা হতো। কিন্তু এখন কম মুরগি তুলছি।

পবার বালানগর এলাকায় মো. কামাল হোসেন মুরগির খামার দেখাশোনা করেন। তার মালিকের পাঁচটি মুরগির খামার রয়েছে। তবে বাচ্চা ও খাবারের দাম বাড়ায় খামারে ব্রয়লার মুরগি তোলেননি তারা। তারা একটি খামারে ব্রয়লার ও অপর খামারে ১০দিন আগে তুলেছেন সোনানি মুরগির বাচ্চা। তারা প্রতিটি সোনালি মুরগির বাচ্চা কিনেছেন ৫০ টাকা দরে। তবে প্রতিটি মুরগি খামারে পৌঁছাতে তাদের খরচ পড়েছে প্রায় ৬০ টাকা।

মো. কামাল হোসেন বলেন, ৪০ দিন আগে আমরা খামারে ৫ থেকে ৭ টাকা দরে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা তুলে ছিলাম। এখন সেই মুরগিগুলো আমরা বিক্রি করছি। এখন ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা প্রতিটি ৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, খাবারের প্রতি বস্তায় দাম বেড়েছে। সেই সঙ্গে দাম বেড়েছে মুরগির বাচ্চাও। আমাদের তিনটা খামার প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। তবে খাবার ও মুরগির বাচ্চার দাম বেড়ে যাওয়ায় বাচ্চা নেওয়া যাচ্ছে না খামারে। তাই খামারগুলো প্রস্তুত অবস্থায় পড়ে আছে। দাম কিছুটা কমলে খামারে ব্রয়লার মুরগি তোলা হবে।

অপর মুরগি বিক্রেতা রাশেদ আলী বলেন, ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ার কারণে কমেছে বিক্রি। আগে প্রতিদিন ৫০টা ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হতো। ওজনের হিসেবে কমপক্ষে ১০০ কেজি। এখন ৩০টা করে ব্রয়লার মুরগি দোকানে নিয়ে আসলেও বিক্রি হচ্ছে না। থেকে যাচ্ছে। বর্তমানে ব্রয়লার মুরগি বাজারে বিক্রি হচ্ছে  প্রতি কেজি ২২০ টাকা দরে। কয়েক মাস আগে যখন ব্রয়লারের দাম প্রতি কেজি ১৫০ টাকা ছিল। তখন ৫০ থেকে ৬০টা করে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হতো। একইভাবে দাম বেড়েছে লেয়ার ও সোনালি মুরগির।

তামিম ফিড কোম্পানির তামিম এন্টি গ্রেড ফার্মের রাজশাহীর সেলস ম্যানেজার মঞ্জুর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে যে কোম্পানিগুলো শুধু ফিড নিয়ে ব্যবসা করতেন। তারা এখন মুরগি লালন-পালন করে বাজারে বিক্রি করছেন। এখন আর তেমন মুরগির খামারি নেই। ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে। সেই প্রভাব বাজার ছাড়াও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপরে পড়েছে।

রাজশাহী পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এনামুক হক বলেন, রাজশাহীতে ৫ হাজার ব্রয়লার মুরগির খামার ছিল। এখন দুই হাজারে নেমে এসেছে। ডিম ও বাচ্চার দাম বেশি, উৎপাদন কম। কোম্পানিগুলো বাচ্চা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। তারা ফিড তৈরি করতে পারছেন না। ফিডের যে উপাদানগুলো লাগে সেগুলো বিদেশ থেকে আনতে সমস্যা হচ্ছে, দাম বেশি। এতে করে খাবারের দাম বেশি হয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এক বছরে পাঁচ দফায় এক বস্তা খাবারের দাম বেড়েছে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসেই খাবারের দাম বেড়ে ছিল। খামারিরা বলছে, আমরাও বলছি- খাবারের দাম বেশি। এমন অবস্থায় মুরগি উৎপাদন করতে খরচ বেশি পড়ে যাচ্ছে। কিছু দিন আগে ব্রয়লারের দাম ছিল প্রতি কেজি ১৫০ টাকা। কিন্তু এখন ২২০ টাকা কেজি।

এক বছরে বাচ্চার দাম কত বেড়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে এনামুক হক বলেন, বাচ্চার দাম হের-ফের হয়। কখনো কমে, কখনো বাড়ে। তবে গত বছরের এই সময়ে বাচ্চার যে দাম ছিল। তার চেয়ে এই বছরে ৮ থেকে ১০ টাকা দাম বেশি। এখন প্রতিটি বাচ্চার দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা কিনতে হচ্ছে খামারিদের।

তিনি বলেন, ব্রয়লার মুরগির ব্যবসাটা কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করে। এটা এক ধরনের সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট সব সময় ছিল। এখনো ভয়াবহ সিন্ডিকেট চলছে। খামারিরা এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এই ব্যবসা সোনায় সোহাগা হয়ে যেত। খামারিরা উৎপাদক, কিন্তু দাম পান না।

ব্রয়লার মুরগি খেলে ক্যান্সার হয় কিনা জানতে চাইলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলী বলেন, ব্রয়লার মুরগির মাংসে ক্যান্সার হতে পারে। কারণ খামারি ব্রয়লার মুরগিতে যে মেডিসিন ব্যবহার করে তা মাত্রায় বেশি। মাত্রায় বেশি হওয়ার কারণে অল্প দিনে একটা মুরগি দ্রুত বড় হচ্ছে। ব্রয়ালারকে খাওয়ানো ওষুধগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত না, তাই ঝুঁকি থেকেই যায়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্সের ডেপুটি চিফ ভেটেরিনারিয়ান হেমায়েতুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্রয়লার আসলে আমেরিকা, ইউরোপ থেকে নিয়ে আসা হয়। সেই দেশগুলোতে তেমন দেশি মুরগি নেই। তবে ব্রয়লারের মাংস খেলে ক্যান্সার হচ্ছে- এমন কোনো গবেষণা আমাদের চোখে পড়েনি। বিশ্বব্যাপী এই রকম কোনো তথ্য নেই।

রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন বলেন, রাজশাহীতে ১৪০০টির বেশি মুরগির খামার আছে। এগুলোতে নিয়মিত মুরগি উৎপাদন হচ্ছে। করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের পরে একটু সংকট তৈরি হয়েছে। এই ফিডের মূল উপাদান ভুট্টা ও সয়াবিন। এগুলোর দাম বেড়েছে। খামারিরা খাবার ও বাচ্চার দাম বেশির কারণে মুরগি তুলতে পারছেন না। দেশের ও বাইরের কোম্পানিগুলো বাচ্চা, খাদ্য ও ভ্যাকসিন দিয়ে দিচ্ছে খামারিদের। এই কোম্পানিগুলো খামারিদের প্রতি কেজিতে ১০ টাকা করে মুনাফা দিয়ে মুরগি কিনে নিচ্ছে।

আরএআর