ফাইল ছবি

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর পরিবেশ দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছে। প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে আরসা ও আল ইয়াকিনের মতো মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠনের চক্ষুশূল হয়ে পড়েছে নিরীহ অনেক রোহিঙ্গা। এ কারণে ক্যাম্পে বসবাসকারীদের মধ্যে আতঙ্ক, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজ করছে প্রতিনিয়ত।

বুধবার (৮ মার্চ) সকালে মুখোশধারী দুর্বৃত্তদের গুলিতে লম্বাশিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা ছৈয়দ হোসেন নিহত হন। এ দিয়ে চলতি বছরের গেলো ২ মাসে দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে খুন হয়েছে ৮ জন রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা নেতাদের দাবি ক্যাম্পে অপরাধ কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা না করায় টার্গেট করে কমিউনিটি নেতাদের খুন করা হচ্ছে।

প্রশাসন বলছে, ক্যাম্পে সংগঠিত ঘটনাগুলো নিয়ে তারা চিন্তিত। তবে যৌথ অভিযানের পাশাপাশি সমন্বিত প্রচেষ্টায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে জানিয়েছে ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএন।

বুধবার সকাল ৮টায় উখিয়ার আশ্রয় শিবিরে আধিপত্য বিস্তারের জেরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে রোহিঙ্গাদের এক নেতা নিহত হন। লম্বাশিয়া ২-ওয়েস্ট নম্বর রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের ডি-ব্লকে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ছৈয়দ হোসেন ওরফে কালাবদা (৫২) উখিয়ার লম্বাশিয়া ২-ওয়েস্ট রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের ডি-ব্লকের আজিজুর রহমানের ছেলে। তিনি আশ্রয় শিবিরটির ডি-ব্লকের মাঝি (কমিউনিটি নেতা) হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।

উখিয়ার ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (এডিআইজি) ছৈয়দ হারুনুর রশিদ বলেন, সকালে উখিয়ার লম্বাশিয়া ২-ওয়েস্ট রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের ডি-ব্লকে নিজের ঘরের পাশে একটি দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এসময় ৭/৮ জন মুখোশধারী একদল দুর্বৃত্তরা তাকে লক্ষ্য করে উপর্যুপরি গুলি ছোড়ে। এতে ছৈয়দ হোসেন গুলিবিদ্ধ হন। খবর পেয়ে এপিবিএন পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।

পরে ঘটনাস্থল থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ছৈয়দ হোসেন উদ্ধার করে কুতুপালং আশ্রয় শিবির সংলগ্ন এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে আসে। এসময় হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এডিআইজি বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে কয়েকটি দুষ্কৃতকারী দল সক্রিয় রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছে, মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্টি আরসার সন্ত্রাসীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে। আর নিহতের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে।

এদিকে গত রোববার উখিয়া পালং খালী ৯, ১০ও ১১নং ৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন, দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা।

স্থানীয়দের দাবি, কোনো বিশেষ গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আধিপত্য বিস্তার ও ষড়যন্ত্র করে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়েছে রোহিঙ্গারাই। তবে তদন্ত কমিটির মাধ্যমেই আগুনের প্রকৃত কারণ বেরিয়ে আসবে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সন্দেহ এক রোহিঙ্গাকে আটক করেছে আমর্ড পুলিশ ও পুলিশ। আটক যুবককে জিজ্ঞাসাবাদের পর বিস্তারিত বলা যাবে বলে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

উখিয়ার বালুখালীতে আগুনে বিরানভূমি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বড় একটি অংশ পুড়ে গেছে। চারপাশে কেবল আগুনে পোড়া ধ্বংসস্তূপ। জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুই হাজারের বেশি ঘর (শেল্টার) পুড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ হাজারের বেশি। ক্যাম্প-১১ আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা থাকেন ৩২ হাজার ২০০। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৯০টির বেশি বেসরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, লার্নিং সেন্টার, ত্রাণকেন্দ্রসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে।

তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কারণ নিয়ে প্রশ্ন সবার। স্থানীয়রা জানান, ক্যাম্প ঘিরে রয়েছে কিছু বিচ্ছিন্নবাদী সংগঠন। তারা হয়তোবা এই ঘটনা ঘটিয়েছে।  অগ্নিকাণ্ডে ঘরবাড়ি হারানোদের দাবি, এটি নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়। একটি পরিকল্পিত ঘটনা।

এ দিকে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, আরসা সদস্যরা তাদের রাজত্ব করতে না পারে  রোহিঙ্গা নেতাদের টার্গেট করে হত্যা করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কমিউনিটি নেতারা সবসময় আরসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ  করছিল। তাই তাদের খুন করা হচ্ছে। গত দুইদিনে ২ কমিউনিটি নেতাকে হত্যা করে আরসার সদস্যরা। গত ২ মাসে ৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এখন ক্যাম্পে কেউ ক্যাম্পভিত্তিক নেতা হতে চায় না। কেন নেতা হতে চাই না প্রশ্ন করলে উত্তরে তিনি বলেন, ক্যাম্পে কী হচ্ছে না হচ্ছে সবকিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দিয়ে থাকে ক্যাম্প মাঝিরা। তাই তাদের হত্যা করে আরসার সদস্যরা। 

১১নং ক্যাম্পের নেতা সৈয়দুল আমিন বলেন, ক্যাম্পের সব বাসিন্দারা আতঙ্কে আছেন। কখন কী হয় সেটা আমাদের জানা নেই। অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত ঘটনা নিয়ে যারা মুখ খুলেছিল তাদের হত্যা করেছে আরসার সদস্যরা। গত দুইদিনে দুইজন ক্যাম্প মাঝিকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এখনো কেউ আটক হয়নি। তাদের প্রত্যেকটি মিশন বাস্তবায়ন হচ্ছে। ক্যাম্পে কখন কী হয় তার ঠিক-ঠিকানা নেই বলে জানান এই রোহিঙ্গা নেতা।

১০নং ক্যাম্পের বাসিন্দা মিয়া বিবি বলেন, এখনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ভুলতে পারছি না। ছেলেমেয়েরা চুলার আগুন দেখলোও ভয় পেয়ে যাচ্ছে। তারমধ্যে ক্যাম্পে খুনাখুনি। এত চাপ আমরা কীভাবে নেব? আমরা আমাদের নিরাপত্তা চাই। 

উখিয়া পালংখালী অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার রবিউল হাসান বলেন, ক্যাম্প অস্থিরতার উঠার প্রধান কারণ বিচ্ছিন্নবাদী রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ। তাদের কারণে এসব খুনাখুনি হচ্ছে। এসব সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছে কিছু কথিত এনজিও সংস্থা বলে অভিযোগ তোলেন এই স্থানীয় নেতা। তিনি আরও জানান খুন-সংঘাত যেন নিত্যদিনের ঘটনা। আমরা স্থানীয়রা অনেক আতঙ্কে আছি। প্রশাসনের উচিত তৎপর  হাওয়া। 

উখিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, গেল ৬ মাসে ক্যাম্পে দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে নিহত হন ১৩ জন রোহিঙ্গা। এসব ঘটনায় ১৩টি মামলা দায়েরের পাশাপাশি গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩৮ জনকে। এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে  আমরা গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছি এবং এই সন্ত্রাস গ্রুপের সদস্যদের চিহ্নিতের কাজ করছ বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ক্যাম্পের অগ্নিকাণ্ডে দুই হাজার ঘর ভস্মীভূত হয়। এতে ১২ হাজার রোহিঙ্গা ঘর হারায়। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা হয়েছে এবং এই ঘটনায় যারা জড়িত তাদেরও চিহ্নিত করে আটকের চেষ্টা চলছে। 

 

আরকে