‘আমি উনার (চিকিৎসক) প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞ। আল্লাহর পর তিনিই (চিকিৎসক) আমাকে সেবা-যত্ন করে সুস্থ করেছেন। আল্লাহর রহমতে উনার (চিকিৎসক) সেবায় আমি বেঁচে আছি।’

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) এক মাস চিকিৎসা নেওয়া ফারিহা আফরিন আইসিইউ ইনচার্জ ডা. আবু হেনা মোস্তফার কথা স্মরণ করে ঢাকা পোস্টকে এসব কথা বলেন। 

ফারিহা গুলেন–বারি সিনড্রোম বা জিবিএস রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৮ সালে হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তবে আইসিইউয়ের ফাঁড়া কাটিয়ে ফিজিওথেরাপি নিয়ে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পুরোদমে শুরু করেন পড়াশোনা। তাতে সফলতাও পেয়েছেন। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। 

গত সোমবার (১৩ মার্চ) মিষ্টি নিয়ে মা লাইলা আঞ্জুমকে সঙ্গে নিয়ে রামেক হাসপাতালের আইসিইউতে হাজির হন ফারিহা। মিষ্টিমুখ করান চিকিৎসক ও নার্সদের। 

ফারিহা আফরিন নগরের বুলনপুর ঘোষপাড়ার বাসিন্দা। সরকারি প্রমথনাথ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (পিএন) থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেন তিনি। এরপর কাশিয়াডাঙ্গা কলেজ থেকে এএইচএসসি সম্পন্ন করেন। ফারিহার বাবা মো. আনোয়ার হোসেন কৃষিভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। মা লায়লা আঞ্জুমান হাজী সাফিনা কলেজের প্রদর্শক। বড় ভাই এলএম হাসনাইন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) পড়াশোনা করেন।

ফারিহা আফরিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সময়টা ছিল ২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর। ওটা আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিন। ওই দিন আমি আইসিইউতে ভর্তি হই। আমার অনুভূতি ছিল, তবে আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। চোখের পাতাও নড়াতে পারছিলাম না। আমি শ্বাসও ঠিক মতো নিতে পারছিলাম না। আমাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। এভাবে একমাস ছিলাম আইসিইউতে। আইসিইউতে ভর্তির প্রায় ১৫ দিন পরে কথা বলতে শুরু করি। ডাক্তারদের বলতাম, স্যার আমি কখন বাড়িতে যাব। ডাক্তার বলতেন, আরও সুস্থ হও, তারপর ছুটি দেওয়া হবে। এভাবে দিন যেতে যেতে ৩১ ডিসেম্বর আমাকে ছুটি দেয়। তখন আমি বাসায় ফিরি। রামেক হাসপাতালের আইসিইউয়ের ইনচার্জ আবু হেনা মোস্তফা স্যার আমার অনেক সেবা করেছেন।

তিনি বলেন, আমি অনেক অসুস্থ হয়ে সংকটের মধ্যে পড়ে ছিলাম। নিউরোলজি চিকিৎসক আমাকে দ্রুত আইসিইউতে রেফার্ড করেছিলেন। তখন আমার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট ছিল। রামেক হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডে ১০টা শয্যা হওয়ায় সবগুলো বেডে রোগী ছিল। তখন বাধ্য হয়ে নগরীর লক্ষ্মীপুরের সিডিএম হাসপাতালের আইসিইউতে আমাকে ভর্তি করেন স্বজনরা। সিডিএম হাসপাতালে একদিন ছিলাম। তারপর আবার রামেক হাসপাতালের আইসিইউতে নিয়ে আসা হয় আমাকে। সেখানে এক মাস চিকিৎসা নিয়ে আল্লাহর রহমনে এখনো ভালো আছি।

ফারিহা আফরিন বলেন, ছোটবেলায় আমার শ্বাসকষ্ট ছিল। আমি নিয়মিত ইনহেলার নিতাম। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াশানা অবস্থায় ভালো হয়ে যায় শ্বাসকষ্ট। যখন চিকিৎসকরা আমার চিকিৎসা করতো তখন থেকেই আমার ইচ্ছা হয়, আমি চিকিৎসক হবো। আমার পরিবারও চায়, আমি ভবিষ্যতে চিকিৎসা বিষয়ে লেখাপড়া করে চিকিৎসক হই। তবে আমাদের বই কিনে পড়ার মতো টাকা ছিল না। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের। আমি বেশির ভাগ সময় ইন্টারনেটে ফ্রি পিডিএফ বই ডাউনলোড করে পড়াশোনা করতাম।

আইসিইউতে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা আসলে বলার মতো না। তারা (চিকিৎসক) আমাকে নিজের বোনের মতো দেখতো। আমি আইসিইউতে থাকা অবস্থায় ১৫ দিনের মাথায় কথা বলতে পারলাম। তখন আমি নার্সদের আপু বলে ডাকতাম। আমি ডাকলেই তারা ছুটে আসতো, আমার কী প্রয়োজন সেটা জানার জন্য। তারা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। ডাক্তার আবু হেনা মোস্তাফা কামাল স্যার আমাকেও অনেক ভালো চিকিৎসা দিয়েছেন। আমি দেখেছি তিনি সব রোগীর সঙ্গে অনেক ভালো ব্যবহার করেন। তাদের কথা শোনেন।

 ডা. আবু হেনা মোস্তফার সঙ্গে ফারিহা ও তার মা

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডের ইনচার্জ ডা. আবু হেনা মোস্তফা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আল্লাহ চেয়েছে বলে সে সুস্থ হয়েছে। আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে সব রোগীকেই আমরা যত্ন নিই। এই মেয়েটি আমাকে মনে রেখেছে। 

কাশিয়াডাঙ্গা কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল করিম শাহ বলেন, মেয়েটি মেধাবী। সে অসুস্থ ছিল, আইসিইউতে ছিল। সে ভালো লেখাপড়া করত। নিয়মিত ক্লাসে আসত। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছে। এ বছর এইচএসসিতে কাশিয়াডাঙ্গা কলেজ থেকে দুইজন জিপিএ-৫ পেয়েছে। তারা দুজনই  বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে ফারিহা একজন। 

ফারিহার মা লায়লা আঞ্জুমান বলেন, মেয়ে তো মরা মরা অবস্থায় ছিল। এক মাস আইসিইউতে ছিল। চিকিৎসকরা ও এলাকাবাসী অনেক সাহায্য করেছে। ফারিয়া সুস্থ হওয়ার পরে এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে। তার ও আমাদের স্বপ্ন ছিল সে ডাক্তার হবে। ডাক্তারি পড়ার লক্ষে সেইভাবে পড়াশোনা করত ফারিয়া। মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়েছে সে। আমি মেয়ের জন্য সবার কাছে দোয়া চাই। 

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের চার নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রুহুল আমিন টুনু জানান, ফারিহা দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিল। অসুস্থকালীন ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করতে না পারলেও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে আইসিইউয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। শুনেছি মেয়েটি মেধাবী। 

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. এফ এম শামীম বলেন, ওই মেয়েটা আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে, এখন সুস্থ আছে। ভালো ফলাফল করায় মেডিকেলে পড়াশোনার সুযোগ হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমি পার্সোনালি অনেক খুশি। আমাদের হাসপাতালে আইসিইউতে অনেক ভালো চিকিৎসা হয়। 

আশিক/আরএআর