অর্থাভাবে এসএসসি পাস করার আগেই দুই বোনের বিয়ে হয়ে যায়। নিজের এসএসসি পরীক্ষার দিন ঘরে খাবার ছিল না। তবে তার অদম্য ইচ্ছার কাছে পরাজয় মেনেছে এমন হাজারো প্রতিকূলতা। এবার মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের ভূমিহীন দিনমজুর মন্টু হাওলাদারের ছেলে সৌরভ হাওলাদার।

যে ঘরে দুবেলা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা নেই, সেই ঘরে এত বড় সুখের খবর যেন পাড়া-প্রতিবেশীদের হতবাক করেছে। আনন্দের বন্যা বইছে পুরো এলাকায়।

মন্টু হাওলাদার বলেন, সৌরভকে লেখাপড়ার কোনো খরচই আমি দিতে পারিনি। দিনমজুরি করে যা আয় হতো তা দিয়ে সংসার চালাতেই কষ্ট হয়ে যেত। তার ওপরে গত দুই বছর ধরে আমি দিনমজুরিও করতে পারি না। রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে আছি।

তিনি বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই সৌরভ মেধাবী। এখনতো মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে। আমি দুশ্চিন্তায় আছি ওর ভর্তির টাকা কোথায় পাব?

সৌরভের মা জুথিকা হাওলাদার বলেন, আমার ছেলে ছোটবেলা থেকে খাবারের কষ্ট করেছে। ঠিকমত নতুন একটা জামাও কিনে দিতে পারিনি। তবে সৌরভ অষ্টম শ্রেণি থেকে গ্রামে টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতো। আর স্কুলে বৃত্তি পাওয়ায় সেই টাকায় লেখাপড়ার খরচ বহন করতো। মেডিকেলে চান্স পাওয়ার খবরে খুব ভালো লাগছে। কিন্তু কীভাবে ভর্তি করবো সেটাই বুঝতেছি না।

তিনি বলেন, আমরা যে ভিটায় থাকতাম তা আমার শ্বশুর আরেকজনের কাছ থেকে কিনেছিলেন। কিন্তু যার কাছ থেকে কিনেছিলেন তার সঙ্গে আরেক পক্ষের মামলা ছিল। মামলায় অন্যপক্ষ জিতে যাওয়ায় আমরা ভূমিহীন হয়ে পড়েছি।

সৌরভ হাওলাদার বলেন, মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় ১২৯৯তম হয়ে আমি বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। আমার স্কোর ৭২ দশমিক ৭৫। ছোটবেলা থেকেই আমি দুর্বিষহ অভাবের মধ্যে বড় হয়েছি। বাবা প্রতিদিন যা আয় করতেন তা সংসারের পেছনেই খরচ হয়ে যেত। আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখন বোনদের বিয়ে হয়ে যায়। আর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর টিউশনি শুরু করি। প্রথমে টিউশনি করালেও অনেকে টাকা দিত না। তবে অষ্টম শ্রেণিতে উঠে পুরোদমে টিউশনি শুরু করি এবং নিজের টাকায় লেখাপড়া শুরু করি। করোনা মহামারির সময়ে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন মায়ের সঙ্গে আলাপ করি- কোনো চাকরিতে ঢুকে পড়ব কিনা। মা তাতে রাজি হননি। যত কষ্টই হোক তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে বললেন।

সৌরভ জানান, পূর্ব নারায়ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পান। এরপরে নারায়ণপুর পল্লী ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উপজেলার মধ্যে প্রথম হয়ে বৃত্তি লাভ করেন। একই বিদ্যালয় থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি এবং গুঠিয়া ডিগ্রি কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। 

তিনি বলেন, সংগ্রাম করে এই পর্যন্ত এসেছি। এখনো দুশ্চিন্তায় আছি ভর্তি নিয়ে। ভর্তি হতে সম্ভবত ১৫ থেকে ২০ হাজারের মতো টাকা লাগে। এত টাকা জোগাড় করতে পারবো কিনা জানি না। তবে টাকা জোগাড় করতে ইতোমধ্যে টিউশনি বাড়িয়ে দিয়েছি। এখন চারটি টিউশনি করাই তাতে মাসে ৫ হাজার টাকার মতো আসে। এই টাকা দিয়েই সংসার, বাবার ওষুধের খরচ চালাতে হয়।

সৌরভ বলেন, আমি চেষ্টা করছি। আশা করি ভর্তির টাকাও সংগ্রহ করতে পারবো।

নারায়ণপুর পল্লী ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনের শিক্ষক মিরোজ তালুকদার বলেন, সৌরভ হাওলাদার নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। কিন্তু অত্যন্ত মেধাবী। ওর আচরণে সব শিক্ষক খুশি। খুব বিনয়ী একটা ছেলে। তার মেডিকেল কলেজে চান্স পাওয়া খবরে শুধু আমরাই নয়, পুরো এলাকাবাসী খুশি। অজপাড়া গায়ের সৌরভ হাজারো প্রতিকূলতার মাঝে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করেছে।

তিনি বলেন, ওর পরিবার এতটাই দরিদ্র যে সৌরভের অন্য দুই বোন এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারেনি। তার আগেই বিয়ে দিতে হয়েছে অভাবের কারণে। সৌরভ যেদিন এসএসসি পরীক্ষা দিতে যায় সেদিন ঘরে ওর কোনে খাবার ছিল না। এতো কঠিন প্রতিকূলতার মধ্যেও আমার ছাত্র মেডিকেলে চান্স পেয়েছে জেনে গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে।

ওই জমির মালিক বলেন, ছোটবেলা থেকেই ওকে আমি যতদূর পেরেছি সাহায্য করেছি। মেডিকেলে পরীক্ষা দেওয়ার আগে সৌরভ আমাকে বলেছিল বাড়ি থেকে যেন উচ্ছেদ করা না হয়। আমি বলেছি, যতদিন ওর লেখাপড়া শেষ না হবে এবং প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন এই ভিটায় থাকুক।

গুঠিয়া ইউনিয়েনর ৬ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মিরাজ হোসেন খান বলেন, সৌরভ মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়ায় এলাকাবাসী খুশি। ওর ভর্তির বিষয়ে আমরা সাহায্য করব। 

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর