২০২০ সালে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান বরিশাল জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. ইমদাদুল্লাহ। তিন বছরেও সেই পদে নতুন কোনো চিকিৎসক সংযুক্ত হয়নি। তার পরের বছর নাক-কান-গলা বিভাগের চিকিৎসক ডা. নাজমুল হাসান বদলি হয়ে যান শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ওই পদটি আজ অব্দি খালি।

আল্ট্রাসনোগ্রামের জন্য নিয়োগ পাওয়া রেডিওলজিস্ট অবসরে যাওয়ার পরে আর কেউ নিয়োগ পাননি। মেডিকেল অফিসার দিয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হলেও তা অনিয়মিত। আবার অ্যানালাইজার মেশিন অকেজো থাকায় রক্ত পরীক্ষা বন্ধ।

অথচ প্রতিদিন ৪ শতাধিক রোগী এই হাসপাতালের বর্হিঃবিভাগে চিকিৎসা নেন। ভর্তি হন ৪৫ জনেরও বেশি। ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়লে পুরো হাসপাতালে অন্য রোগীদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা থাকে না। এটি শুধু দুই বা তিন বছরের চিত্র এমন কিন্তু নয়, প্রতিষ্ঠার ১১০ বছর অতিক্রম করলেও বরিশাল জেনারেল হাসপাতালটি আধুনিক চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠেনি।

যদিও তিন দফায় ২০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। তবে সেবার মান বাড়েনি কিঞ্চিতও। বরং পদে পদে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সেবা প্রত্যাশীরা।

জনবল সংকট, কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারিতা, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও দালালচক্রের ভয়াবহ দৌরাত্ম যুগ যুগ ধরে দুর্ভোগ আর অনিয়মের প্রতিষ্ঠান হিসেবে করে রেখেছে। হাসপাতালটি কার্যত আধুনিকায়নের জন্য ইতোপূর্বে আন্দোলন হলেও তার সুফল আসেনি।

জেনারেল হাসপাতালের প্রশাসনিক দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, মোট ২৭৯টি পদের মধ্যে ৫৮টি গুরুত্বপূর্ণ পদ এখনও খালি রয়েছে। এরমধ্যে প্রথম শ্রেণিভুক্ত চিকিৎসকদের ৩৪ পদের বিপরীতে কনসালট্যান্ট ১২টি খালি, দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত সেবিকাদের ১৮৪টি পদের বিপরীতে ১৩টি দায়িত্বশীল পদ খালি, তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত থেরাপিস্ট-টেকনোলজিস্টসহ মোট ২৭ কর্মচারী পদের বিপরীতে ১৩ পদ খালি এবং চতুর্থ শ্রেণিভুক্ত কর্মচারীর ৩৪ পদের বিপরীতে ২০ পদ খালি। গত ১৫ দিনে ২৯০০ জন রোগী বর্হিঃবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন আর ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৪০০ জন।

সরেজমিনে হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত রোগীদের ভিড় লেগেই থাকে। বিভিন্ন রোগ নিয়ে শুধু বরিশাল শহর বা আশপাশের উপজেলার নয় বিভাগের বিভিন্ন উপজেলা থেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। হাসপাতালের গেট পাড় হলেই প্রথমে রোগীদের দালালদের ফাঁদে পড়তে হয়।

বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের কাগাশুরা গ্রামের বাসিন্দা বাদল বেপারী বলেন, হাসপাতালে যে কয়জন চিকিৎসক রয়েছেন তারা আন্তরিকতার সঙ্গেই রোগী দেখেন। কিন্তু দালালদের দাপটে চিকিৎসা পাওয়া অসম্ভব। বর্হিঃবিভাগের সামনে গিজগিজ করে দালালে। ডাক্তার পরীক্ষা লিখলেই প্রেসক্রিপশন ছিনিয়ে নিয়ে রোগীদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে বাধ্য করেন।

গৌরনদীর বাসিন্দা সাবেক নার্স রোকসানা বলেন, জেনারেল হাসপাতালে রোগীর দুই মিনিট কথাও শোনেন না ডাক্তাররা। অথচ তারাই চেম্বারে গেলে আধাঘণ্টারও বেশি সময় ধরে কথা শোনেন। এখানে কথা শেষ করার আগেই প্রেসক্রিপশন লিখে ধরিয়ে দেয়।

জাহানারা বেগম নামে এক রোগী জানান, গাইনি সমস্যা নিয়ে ডাক্তার তানিয়া আফরোজের কাছে চিকিৎসা নিতে যতবার এসেছেন ততবারই তাকে পরীক্ষার জন্য বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়েছেন।

নাজিরপুর থেকে আসা রোগী শহিদুল ইসলাম বলেন, ডাক্তার আশিকুর রহমানের অধীনে তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও সরকারি কোনো ওষুধ আর শারীরিক পরীক্ষার সুবিধা পাওয়া যায় না। এগুলোই আশিকুর রহমান বাইরের যে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চেম্বার করেন সেখান থেকে পরীক্ষা করার।

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য সেলিম হাওলাদার বলেন, হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সদের আন্তরিকতা ভালো। তবে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর ওষুধ এখানে পাইনি। হাসপাতালের বর্হিঃবিভাগে দালালচক্র সার্বক্ষণিক থাকেন। গ্রামের সহজ-সরল মানুষ পেলেই ভুলভাল বুঝিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যান।

চারজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হয় হাসপাতালের পরিস্থিতি নিয়ে। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে যেমন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চুক্তি থাকে তেমনি থেরাপিস্ট, টেকনোলজিস্টদের সাথেও চুক্তি থাকে। এজন্য বছরের পর বছর ধরে হাসপাতালে আধুনিকসব যন্ত্রপাতি থাকলেও তা অদ্ভুদ কারণে অকেজো করে রাখা হয়। মূলত শতাংশের ভাগে ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে প্রতিদিন টাকা পান চিকিৎসক ও কর্মচারীরা বিধায় ইচ্ছা করেই পরীক্ষা-নীরিক্ষার সরঞ্জাম বন্ধ রাখা হয়।

ওই চিকিৎসকরা জানান, নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালের সামনে বা নিকটস্থ এলাকায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমতি দেওয়া অন্যায্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সকল সরকারি হাসপাতালের সামনে ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে এবং সেগুলোর অনুমতি দিচ্ছেন সিভিল সার্জন বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। চিকিৎসকদের অভিমত প্রান্তিক এসব হাসপাতাল সুচিকিৎসার কেন্দ্র গড়ে তুলতে হলে ঊর্ধ্বতনদের সৎ ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
 
জেনারেল হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আশিকুর রহমান বলেন, কার্ডিওলোজি, হৃদরোগ, শিশু বিভাগ, প্যাথলজি এবং চক্ষু বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কনসালট্যান্ট নেই। এজন্য এসব রোগে আক্রান্ত রোগীরা এখানে এলে আমরা চিকিৎসা দিতে পারি না। তাদের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাই। সেখানে লোকবল ও চিকিৎসক সংকট আরও বেশি চরম। আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করছি যেন হাসপাতালে লোকবল সংকট দূর করা হয়। তাহলেই ধীরে ধীরে হাসপাতালটি থেকে মানুষ সব ধরনের সেবা পাবেন।

জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মলয় কৃষ্ণ বড়াল জানান, আমাদের সংকটের কথা মন্ত্রণালয়ে বারবার জানানো হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই এসব সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। তবে সংকট থাকলেও চিকিৎসকদের আন্তরিকতার অভাব নেই। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি রোগীকে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে।

বরিশালের সিভিল সার্জন ডা. মারিয়া হাসান জানান, জেনারেল হাসপাতালে লোকবল সংকট থাকলেও চিকিৎসা সেবায় কোনো সমস্যা নেই। যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত রয়েছেন তারা সর্বাত্মক সেবা প্রদান করেন। তবে তিনি স্বীকার করেন লোকবল সংকটে পরিপূর্ণ চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না অনেক সময়ে।

প্রসঙ্গত, নগরীর জেলখানা সংলগ্ন এলাকায় ১৯১২ সালে ২০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করে বরিশাল জেনারেল হাসপাতাল। ৯০ দশকে আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৮০ করা হয়। ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় আরও ২০ শয্যা সংযুক্ত করা হয় ২০১৬ সালের দিকে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

এমএএস