মাদারীপুরের শিবচরে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে গতকাল যে বাসটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে সেই বাসের বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের দু’জন রিনা বেগম ও তার ছেলে জুয়েল। কেরানীগঞ্জ কলম ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন রিনা ও তার ছেলে। 

কী হয়েছিল দুর্ঘটনার সময়? রিনা জানালেন, হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে সামনের সিটে ধাক্কা লেগে দু’জন নিচে পড়ে যাই, তারপর কী যে হলো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।  

দুর্ঘটনায় জুয়েলের মাথা ফেটে যায়। কিন্তু জুয়েল বা তার মা কারোরই জ্ঞান ছিল না।   

আরও পড়ুন : ইঞ্জিন কাভার ও সামনের সিটের যাত্রীদের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি

রিনা বলেন, আল্লাহ স্বয়ং ফেরেশতা পাঠায়া আমাগো বাঁচাইছে। আমার সামনের সিটে যে বসা ছিল সে কিন্তু মারা গেছে। কিন্তু আল্লাহ আমারে বাঁচাইছে। আমি তো মনে করেছিলাম যে আমাকে আর মা বলে ডাকার কেউ থাকবে না।  

তিনি আরও বলেন, দু’দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছিলাম আমাদের পারিবারিক একটি জমির ঝামেলার জন্য। আমার জ্ঞান আসার কয়েক ঘণ্টা  পর আমার ছেলের জ্ঞান আসে। এর আগে আমি আল্লাহকে ডেকেছি। আল্লাহ  তুমি আমার সবকিছুর বিনিময়ে আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও। বাবামরা ছেলেটা একটু সুস্থ করে দাও। এর কিছুক্ষণ পরে দেখি আমার ছেলের জ্ঞান ফিরেছে। 

রিনা বেগম বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়িটি অনেক গতিতে চলছিল। পদ্মাসেতুতে যেতে আর সময় লাগবে ২০ মিনিট। এমন আলোচনা করছিল আমার সামনের সিটে বসা এক যাত্রী। হঠাৎ করেই গাড়িটি রাস্তা থেকে ছিটকে যায়।  

অতিরিক্ত গতির কারণে দুর্ঘটনা 
গতকালের এই দুর্ঘটনা অতিরিক্ত গতির কারণে হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাদারীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মাসুদ আলম। দুর্ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, অতিরিক্ত গতির কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। বেপরোয়া গতিতে চালানোর কারণে বাসটি এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যায়। যদি গতি নিয়ন্ত্রণ করে বাসটি চালাত তাহলে ২০ জনের জীবন এভাবে ঝরে যেত না। 

আরও পড়ুন : নিহতদের দাফনে ২৫ হাজার, আহতদের ৫ হাজার টাকা প্রদান

ওই বাসের এক যাত্রী গোপালগঞ্জের কাশিয়ানির উজ্জ্বল বলেন, ‘শুরু থেকেই বাসটি দ্রুতগতিতে চলছিল। এক্সপ্রেসওয়েতে যাত্রীদের অনেকেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলেন। কেউ কেউ চোখ বন্ধ করে ঝিমাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনার সময় কিছুই টের পাইনি। জ্ঞান ফিরলে দেখি, চারপাশে রক্ত আর লাশ। রক্ত দেখার পরে আমার জ্ঞান হারিয়ে যায়। পরে যখন টের পাই দেখি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। সড়ক থেকে গাড়ি উল্টে নিচে পড়ে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে।’ 

আহত ইমামুল হোসাইন সাগরের খালা রেহানা বলেন, আমার ভাগ্নি খুলনার সোনাডাঙ্গা এলাকা থেকে ইমাদ পরিবহনে ঢাকায় আসছিলেন। গাড়ির অনেক গতি ছিল তাই আজ আমার বোনের মৃত্যু হয়েছে। 

পরিচয় মিলেছে ১৭ জনের 
বাস দুর্ঘটনায় নিহত ২০ জনের মধ্যে ১৭ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ৭ জনই গোপালগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা।

পুলিশ ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, দুর্ঘটনায় নিহত ২০ জনের মধ্যে ১৭ জনের মরদেহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটি কক্ষে রাখা হয়। বাকি দুজনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ জনের নাম-পরিচয় মিলেছে। 

আরও পড়ুন : মাদারীপুরে বাস দুর্ঘটনা : শেষ হলো উদ্ধার অভিযান

গোপালগঞ্জের নিহত ৭ জন হলেন- গোপালগঞ্জ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক অনাদী রঞ্জন মজুমদার (৫০), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও সদরের মাসুদ মিয়ার মেয়ে সুইটি আক্তার (২২), সদরের মাসুম মিয়ার ছেলে মোস্তাক শেখ (৪১), টুঙ্গিপাড়ার মো. কাঞ্চন শেখের ছেলে শেখ কবির হোসেন (৫৭), ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সদরের আবু হেনা মোস্তফার মেয়ে আফসানা মিমি (২৫), একই উপজেলার নওশাদ শেখের ছেলে সজীব (২৭), গোপিনাথপুরের তৈয়ব আলীর ছেলে হেদায়েত মিয়া (৫৫)। বাকিদের নাম-পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। 

অন্যান্য জেলার নিহতরা হলেন- মুকসুদপুরের মো. আমজাদ আলীর ছেলে মাসুদ মিয়া (৩৫), খুলনার সোনাডাঙ্গার শেখ আহমদ মিয়ার ছেলে শেখ আব্দুল আল মামুন (৪২), নড়াইলের লোহাগাড়ার বকু শিকদারের ছেলে ফরহাদ হোসেন (৬৭), ফরিদপুর আলফাডাঙ্গা এলাকার শহিদ মুরাদ আলীর ছেলে ইসমাইল হোসেন (২৮), বনগ্রাম এলাকার শামসুল শেখের ছেলে মোসতাক আহম্মেদ (৪৭), ডুমুরিয়া এলাকার পরিমল সাদু খায়ের ছেলে মহাদেব কুমার সাদু খা (৫৫), আমতলা এলাকার শাহজাহান মোল্লার ছেলে আশফাকুর জাহান লিংকন (২৬) এবং বাগেরহাটের শান্তি রঞ্জন মজুমদারের ছেলে অনাদি মজুমদার (৩০)।  বাসচালক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলী আকবরের ছেলে জাহিদ হাসান ও  চালকের সহকারী মো. মিরাজ।

রাকিব হাসান/এনএফ