বন্যায় সর্বস্বান্ত হওয়া বানভাসি মানুষদের একজন আব্দুর রহিম বকস। ১০ বারের বেশি নদীভাঙনের শিকার হয়েছেন তিনি। অবশেষে ভিটেমাটি হারিয়ে আপন গণ্ডি ছেড়ে বাঁচার তাগিদে চলে আসেন রংপুরে। এখন পীরগাছার ছাওলা ইউনিয়নে তিস্তার কোলঘেঁষা চর গাবুরা গ্রামে পরিবার নিয়ে থাকেন। একসময় নিজের জমিতে চাষাবাদ করলেও রহিম বকস আজ গৃহহীন, উদ্বাস্তু। বর্তমানে যাযাবর জীবনে কখনও অন্যের জমিতে কৃষিশ্রমিক, নয়তো ধু-ধু বালুচরে টানছেন ঘোড়ার গাড়ি। এভাবে বছর পাঁচেক ধরে জীবন বাঁচাতে লড়ে যাচ্ছেন তিনি।

আব্দুর রহিম বকস গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা। ২০১৮ সালের বন্যার সময় তিস্তার পানিতে তিনি সর্বস্বান্ত হন। তার মতো অনেকেই এখন পীরগাছা, গঙ্গাচড়া, কাউনিয়াসহ রংপুরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছেন। গৃহহীন মানুষগুলোর অনেকেই আজ বস্তিবাসী। একসময় তাদের মধ্য অবস্থাপন্ন অনেকেই আজ দিনমজুরসহ সাধারণ স্তরের পেশা বেছে নিয়েছেন। অনেকে হয়েছেন রিকশাচালক। বয়স্ক-শক্তিহীন মানুষদের একটি অংশ হয়ে পড়েছেন ভিখারি। শিশুরা শিক্ষাহীন হয়ে পড়েছে। আবার বাধ্য হয়ে অনেকে শিশুশ্রমেও জড়িয়ে পড়েছে। পুরুষদের একটা অংশ কাজের আশায় ছড়িয়ে পড়েছেন দেশের বিভিন্ন এলাকায়।

৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা অববাহিকার ১১৫ কিলোমিটার পড়েছে বাংলাদেশে। তিস্তা আন্তর্জাতিক নদী হওয়া সত্ত্বেও ভারত একতরফা বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং প্রায় ছয় লাখ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর বাংলাদেশের জন্য পানি ছাড়ে। যে পানি আশীর্বাদ না হয়ে বেশির ভাগ সময়ে এ দেশের মানুষের জন্য বয়ে আনছে অভিশাপ। ফলে অসময়ে তিস্তাপাড়ে বন্যা দেখা দিচ্ছে, বছর বছর বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। যার শিকার আব্দুর রহিম বকসের মতো তিস্তাপাড়ে বসতবাড়ি গড়ে তোলা মানুষজন

শুধু পানির জন্যই জীবনে এমন দুর্ভোগ, দুর্দশা আর বঞ্চনা সইতে হচ্ছে বলে দাবি করেন পঞ্চাশোর্ধ আব্দুর রহিম বকস। নিজের মাটি, ভাষা ও সংস্কৃতির মায়া ছেড়ে উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণায় কাতর এ দিনমজুর বলেন, ‘আমার ঘরবাড়ি ছিল। ফসলের জমি ছিল। সবকিছু তিস্তা নদী কেড়ে নিয়েছে। যখন পানির দরকার তখন তিস্তাতে পানি থাকে না। আর অসময়ের পানিতে আমরা ডুবে মরি। তিস্তার পানি যেমন অনেক কিছু দিয়েছে, তারচেয়েও অনেক বেশি কেড়ে নিয়েছে। আজ আমি অন্যের জমিতে আশ্রিত। আমার মতো অনেকের এখন কিছুই নেই।’

পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের পর দেশের চতুর্থ বৃহত্তম প্রমত্তা নদী তিস্তা। উত্তর সিকিমে সোলাস হ্রদ থেকে শুরু করে হিমালয় পর্বতের বুক চিরে ভারতের জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার ছাতনাই দিয়ে তিস্তা এ দেশে প্রবেশ করেছে। ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা অববাহিকার ১১৫ কিলোমিটার পড়েছে বাংলাদেশে। তিস্তা আন্তর্জাতিক নদী হওয়া সত্ত্বেও ভারত একতরফা বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং প্রায় ছয় লাখ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর বাংলাদেশের জন্য পানি ছাড়ে। যে পানি আশীর্বাদ না হয়ে বেশির ভাগ সময়ে এ দেশের মানুষের জন্য বয়ে আনছে অভিশাপ। ফলে অসময়ে তিস্তাপাড়ে বন্যা দেখা দিচ্ছে, বছর বছর বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। যার শিকার আব্দুর রহিম বকসের মতো তিস্তাপাড়ে বসতবাড়ি গড়ে তোলা মানুষজন।  

তিস্তা-বেষ্টিত রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার চরাঞ্চল ঘুরলে আব্দুর রহিমের মতো এমন অসংখ্য মানুষের খোঁজ মিলবে। যাদের বেশির ভাগই এখন ঘুরে দাঁড়াবার প্রত্যয়ে করে যাচ্ছেন ফসলের সংগ্রাম, সবুজের সংগ্রাম। কিন্তু এ সংগ্রামেও নেই স্বস্তি, নেই সুখ। কারণ, তিস্তার পানি প্রাপ্তির ন্যায্য হিস্যার অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় প্রতি বছর লোকসানের মুখে পড়ছে অত্র অঞ্চলের কৃষি ও কৃষকরা। সেচ খরচ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাহত হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত চাষাবাদ। বছরের পর বছর কাঙ্ক্ষিত তিস্তার বুকে ধু ধু বালুচরের বিস্তৃতি বাড়ায় মরুভূমির পথে হাঁটছে উত্তরের জীবনরেখা

তিস্তা-বেষ্টিত রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার চরাঞ্চল ঘুরলে আব্দুর রহিমের মতো এমন অসংখ্য মানুষের খোঁজ মিলবে। যাদের বেশির ভাগই এখন ঘুরে দাঁড়াবার প্রত্যয়ে করে যাচ্ছেন ফসলের সংগ্রাম, সবুজের সংগ্রাম। কিন্তু এ সংগ্রামেও নেই স্বস্তি, নেই সুখ। কারণ, তিস্তার পানি প্রাপ্তির ন্যায্য হিস্যার অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় প্রতি বছর লোকসানের মুখে পড়ছে অত্র অঞ্চলের কৃষি ও কৃষকরা। সেচ খরচ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাহত হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত চাষাবাদ। বছরের পর বছর কাঙ্ক্ষিত তিস্তার বুকে ধু ধু বালুচরের বিস্তৃতি বাড়ায় মরুভূমির পথে হাঁটছে উত্তরের জীবনরেখা।

গঙ্গাচড়া উপজেলার চর ইছলিতে কথা হয় ষাটোর্ধ কৃষক মফিজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘হামরা নদীপাড়ের মানুষ। সুখ-দুক্কের হিসাব করার সময় নাই। খরা, বান-সাঁতাওয়ের সঙ্গে হামার বসবাস। এ তিস্তা নদী হামাক কোনো সময় কান্দায়, ফির হাসায়। এবার চরোত ভালোয় আবাদ হইছে। যদিও পানির অভাবে খরচাপাতি বেশি নাগচে। কিন্তু যেপাকে দেকমেন খালি সবুজ ক্ষ্যাত চোকোত পড়বে। এ্যালা এই ফসল হাটোত তুলি ভালো দামে ব্যাচা নিয়্যায় হামার চিন্তা।’

ভারত থেকে বাংলায় বহমান তিস্তাকে বলা হয় উত্তরের জীবনরেখা। মাস পাঁচেক আগেও এ নদী ছিল পানিতে টইটুম্বুর। এখন পানি নেই, নৌকার পাল তুলে নেই মাঝির হাঁকডাকও। পানিশূন্য তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে চর। এসব চরে ফসল ফলিয়ে খাদ্যের জোগান দিয়ে নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে যাচ্ছেন মফিজুলের মতো কৃষকরা। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা এ মানুষগুলো ক্ষুব্ধ পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়াসহ তিস্তা চুক্তি ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি না থাকায়।

তিস্তার কোলেপিঠে থেকে প্রতি বছর বন্যায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাদের কাছে নদীশাসনের প্রতিশ্রুতি এখন গল্পের মতো। তাই তাদের মনে নদীর তলদেশের মতো ক্ষোভের ভরাটের কমতি নেই। তিস্তাপাড়ের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, আমরা ত্রাণ চাই না। আমাদের নদী খনন করা হোক। বাঁধ দেওয়া হোক। শুনেছি চীনের সঙ্গে সরকার চুক্তি করবে। তিস্তাপাড়ের দুই ধারে খনন, বাঁধ, বড় বড় রাস্তা করবে। শহরের মতো এখানে বিদেশিরা আসবে, পর্যটন স্পট হবে। তিস্তাপাড় হয়ে উঠবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো সুন্দর নগরী। আমরা তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ দেখতে চাই।

এখন নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে বর্ষায় একটু পানি হলেই পাড় উপচে পড়ে। বর্ষার সময় নির্ধারণ করা নদীর বিপদসীমার পরিমাণও অনেক উপরে উঠে গেছে। ১৯৭৯ সালে ডালিয়া পয়েন্টে বর্ষায় তিস্তার পানি প্রবাহের বিপদসীমা নির্ধারণ করা হয় ৫২ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার। সেসময় শুষ্ক বা বর্ষার সময় তিস্তা ছিল স্বাভাবিক গতির একটি নদী। এখন বর্ষায় একটু পানি হলেই তলদেশ ভরা এবং চরের পর বিশাল চর জেগে ওঠা তিস্তা বিপদসীমা অতিক্রম করে। পানিপ্রবাহ ব্যাহত করে তিস্তা বাঁধের কারণে পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের যে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে তার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৩৫ বিলিয়ন ডলার।

তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় ২০১৪ সালে বোরো মৌসুমে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু সেই বছর সেচ দেওয়া সম্ভব হয় মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সেচ দেওয়া হয় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৭ সালে মাত্র আট হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে ৩৫ হাজার হেক্টর, ২০১৯ ও ২০২০ সালে তা বেয়ে ৪০ হাজার হেক্টরে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হয়। তবে, এবার তা কমে ৩৫ হাজার হেক্টরে দাঁড়াবে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড

কমছে সেচের পানি, বাড়ছে ধু ধু বালুচর

রংপুর বিভাগ মূলত চরের জন্য বেশ সুপরিচিত। বিভাগে ছোট-বড় মিলিয়ে এমন চরের সংখ্যা ছয় শতাধিক। শুকনো মৌসুম ছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময় এসব চরে নানা ধরনের ফসল ফলিয়ে থাকেন কৃষকরা। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এসব ফসল চলে যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে। কিন্তু ফসল উৎপাদনে সবচেয়ে বড় সমস্যা পানি। চাহিদা অনুযায়ী পানি না পাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। দিন দিন তিস্তা সেচ প্রকল্পের পানি বণ্টনের হিসাবটাও সংকুচিত হয়ে আসছে।

জানা গেছে, তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় ২০১৪ সালে বোরো মৌসুমে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু সেই বছর সেচ দেওয়া সম্ভব হয় মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সেচ দেওয়া হয় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৭ সালে মাত্র আট হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে ৩৫ হাজার হেক্টর, ২০১৯ ও ২০২০ সালে তা বেয়ে ৪০ হাজার হেক্টরে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হয়। তবে, এবার তা কমে ৩৫ হাজার হেক্টরে দাঁড়াবে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রকল্প এলাকায় সেচ দেওয়া এবং নদীর প্রবাহমাত্রা ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে স্বাভাবিক প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি। শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন প্রায় ১৪ হাজার কিউসেক। আর নদীর অস্তিত্ব বাঁচাতে প্রয়োজন ছয় হাজার কিউসেক পানি। কিন্তু শুকনো মৌসুমে তিস্তায় প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যায় না।

শুষ্ক মৌসুমে বোরো আবাদের সময় ব্যারাজ পয়েন্টে বিগত কয়েক বছর ধরে পাওয়া যায় মাত্র দুই থেকে তিন হাজার কিউসেক পানি। যে সামান্য পরিমাণ পানি তিস্তা নদীতে পাওয়া যায় তার সবটুকু সেচ চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের সেচ খালের মাধ্যমে কৃষি জমিতে সরবরাহ করা হয়। ব্যারাজের ৪৪টি গেট বন্ধ রেখে সেচ প্রকল্পে পানি সরবরাহ করায় মূল নদীতে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে ধু ধু বালুচরে পরিণত হয়। বর্তমানে তিস্তা সেচ প্রকল্পে এক হাজার ৪৭৫ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলমান। যা ২০২৪ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা।

এ বিষয়ে রংপুর বাপাউবো উপপ্রধান সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ অমলেশ চন্দ্র রায় বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার সেচ সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা কমে এসেছে। এর অন্যতম কারণ নদীতে দিনদিন পানিপ্রবাহ কমে আসছে। এবার সেচ সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে নীলফামারী সদর, ডোমার, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর মিলে ২৫ হাজার হেক্টর জমি; রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় সাত হাজার হেক্টর জমি; দিনাজপুরের খানসামা ও চিরিরবন্দর উপজেলায় তিন হাজার হেক্টর জমি।

অস্তিত্ব রক্ষার পানিটুকু নেই

তিস্তা ব্যারাজের (ডালিয়া) পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক সূত্রে জানা যায়, সেচ প্রকল্প এলাকায় পানি সরবরাহ এবং তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে ২০ হাজার কিউসেকের বেশি পানিপ্রবাহ থাকা প্রয়োজন। শুধু নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন ছয় হাজার কিউসেক পানি। সেখানে গড়ে ৫০০ কিউসেক পানি পাওয়া যায় না। এতে নদী বাঁচবে কীভাবে আর সেচ কাজ চলবে কীভাবে— সেই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই।

১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে তিস্তার পানিপ্রবাহ ছিল এক হাজার ৩৩ কিউসেক, ২০০১ সালে চার হাজার ৫৩০ কিউসেক, ২০০২ সালে তিন হাজার ৪০৬ কিউসেক, ২০০৩ সালে তিন হাজার কিউসেক, ২০০৪ সালে দুই হাজার ১০০ কিউসেক, ২০০৬ সালে দুই হাজার ৫০ কিউসেক, ২০০৭ সালে ৯২৫ কিউসেক, ২০০৮ সালে ৬৫০ কিউসেক, ২০০৯-২০১৩ সালে এ প্রবাহ পাওয়া যায় অনুরূপ। ২০১৪ সালের পর থেকে শুকনো মৌসুমে ২০০-৫০০ কিউসেক পানি পাওয়া যায় বলে জানা গেছে। যেটুকু পানি আসছে তা বাঁধ চোয়ানো

নদীর কম-বেশি স্বাভাবিক প্রবাহকে কিউসেকে পরিমাপ করে উল্লেখ করা হয়। প্রতি সেকেন্ডে এক ঘনফুট পানি প্রবাহকে কিউসেক বলে। কিন্তু বর্তমানে গজলডোবা ব্যারাজের ফাঁকফোকর দিয়ে চোয়ানো পানি কোনোভাবেই পরিমাপযোগ্য পরিমাণ নয় বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত শুকনো মৌসুম ধরা হয়। এ সময়কালে বাংলাদেশ প্রান্তে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের জন্য কমপক্ষে ১০ হাজার কিউসেক পানি প্রয়োজন। সেখানে শুকনো মৌসুমে পাওয়া যাচ্ছে গজলডোবা ব্যারাজ চোয়ানো কোনো রকমে ২৫০ কিউসেক পানি।

তিস্তাসহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন বামধারার বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠক। তাদেরই একজন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) রংপুর জেলার সমন্বয়ক আব্দুল কুদ্দুস। এই রাজনীতিবিদ বলেন, তিস্তাকে বাঁচাতে যে পরিমাণ পানির প্রবাহ থাকা দরকার, তা কিন্তু নেই। বরং তিস্তাকে পানিশূন্য করে এ অঞ্চলকে মরুকরণের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যাসহ ভারত থেকে আগত সব আন্তর্জাতিক নদীর পানিবণ্টনের বিষয়টি ভারত সরকার বিভিন্ন অজুহাতে ঝুলিয়ে রেখেছে। ভারতের শাসকগোষ্ঠী তাদের হীন স্বার্থে নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে কখনও পানি সমস্যাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়েছে। কখনও সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার নামে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করেছে। একইভাবে বর্তমান সরকারসহ অতীতের সব সরকার নির্লজ্জভাবে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতের আগ্রাসী পানির নীতিতে সমর্থন জুগিয়েছে।

যেটুকু পানি আসছে তা বাঁধ চোয়ানো

রংপুরের গবেষণাধর্মী লেখক রানা মাসুদ তার ‘তিস্তার আদ্যোপান্ত’ বইয়ে লিখেছেন, আন্তর্জাতিক নদীর পানির ব্যবহারে শক্তিশালী রাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্যবাদের কদর্য রূপ আর ততোধিক নগ্ন চিত্র গজলডোবা ব্যারাজের মাধ্যমে অভিন্ন নদী তিস্তার ক্ষেত্রে ফুটে উঠেছে। তিস্তার পানিপ্রবাহের গত বছরের পরিসংখ্যান দেখলেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করা যাবে। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে তিস্তার পানিপ্রবাহ ছিল এক হাজার ৩৩ কিউসেক, ২০০১ সালে চার হাজার ৫৩০ কিউসেক, ২০০২ সালে তিন হাজার ৪০৬ কিউসেক, ২০০৩ সালে তিন হাজার কিউসেক, ২০০৪ সালে দুই হাজার ১০০ কিউসেক, ২০০৬ সালে দুই হাজার ৫০ কিউসেক, ২০০৭ সালে ৯২৫ কিউসেক, ২০০৮ সালে ৬৫০ কিউসেক, ২০০৯-২০১৩ সালে এ প্রবাহ পাওয়া যায় অনুরূপ। ২০১৪ সালের পর থেকে শুকনো মৌসুমে ২০০-৫০০ কিউসেক পানি পাওয়া যায় বলে জানা গেছে। যেটুকু পানি আসছে তা বাঁধ চোয়ানো।

শুষ্ক মৌসুমে সরু নালার মতো প্রবাহ দিয়ে হাঁটুজল নিয়ে চলছে তিস্তার জীবন। ২০১৪ সালে ভারত তিস্তার পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ অংশে তৃষ্ণার্ত বুকে পানির জন্য ছটফট করতে থাকা তিস্তা এখন মৃতপ্রায়। গজলডোবার বাঁধ চোয়ানো পানিতে নেই বাঁচার আলো। বরং দিনের পর দিন তিস্তা তীরবর্তী ও আশপাশের প্রকৃতি রুগ্ণ হয়ে আজ মরুকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

পানিশূন্যে ভরাট তলদেশ, অল্পতেই বন্যা

মৃত তিস্তার তলদেশে অজস্র পাথর, নুড়ি, বালি আর পলি পড়েছে। পানিশূন্য তিস্তার বুকজুড়ে শুষ্ক মৌসুমে উত্তপ্ত বালুর স্তূপ। নাব্যতা বা স্রোত না থাকায় নদীর তলদেশ ভরাটের ধারাবাহিকতা খুব দ্রুত বেগে ঘটেছে। মাইলের পর মাইল জেগে ওঠা চরে ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্ন বুনন করে আসছে তিস্তাপাড়ের মানুষ। কিন্তু গজলডোবা ব্যারাজের মাধ্যমে তিস্তা নদীর অব্যাহত পানি প্রত্যাহার সেই স্বপ্ন বুননে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তারপরও থেমে থাকে না নদীনির্ভর চাষাবাদ। কিন্তু ভরা বর্ষায় ভারত থেকে ছেড়ে দেওয়া পানিতে বারবার ডুবে যাচ্ছে ঘুরে দাঁড়াবার সেই স্বপ্ন। বর্ষা এলে পানি বাড়ায় গজলডোবা ব্যারাজ যখন আর পানি ধরে রাখতে পারে না, তখন ব্যারাজের সবগুলো কপাট খুলে দেওয়া হয়।

অসময়ে ছেড়ে দেওয়া ভারতের পানি তীব্র বেগে ছুটে আসে ভাটির দিকে। এ বিপুল পানি  ধরে রাখতে পারে না তিস্তার গতর। মুহূর্তেই উপচে প্লাবিত হয় নদীপাড়ের দুই কূল, দেখা দেয় তীব্র বন্যা। সেই সঙ্গে চলে নদীভাঙন। পানির তৃষ্ণা নিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া তিস্তা তখন পরিণত হয় অশান্ত রাক্ষসী নদীতে। সেই পানিতে আব্দুর রহিম বকস, মোকছেদুল ইসলামের মতো হাজার হাজার মানুষের স্বপ্ন ডুবে যায়। ক্ষতি হয় ঘরবাড়ি, ভিটেমাটিসহ বিপুল পরিমাণ ফসল ও গবাদিপশুর।

এমন পরিস্থিতিতে নদী গবেষক ও উন্নয়ন বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষিজমি কমতে থাকায় চরগুলোই দেশের ভবিষ্যৎ খাদ্যের জোগানের কেন্দ্রবিন্দু। তারা মনে করছেন, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি তিস্তা নদীর সুরক্ষার বিষয়টিও এখন জরুরি।

তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শফিয়ার রহমান বলেন, প্রতি বছর দেশে শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ কৃষিজমি কমছে। কিন্তু পরিমাণ বাড়ছে চরের। তাই চরের কৃষি ব্যবস্থাপনায় বিশেষ প্রকল্পের পাশাপাশি বন্যা, খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনীয় নানা রকম ফসলের জাত উদ্ভাবনের ওপর নজর দেওয়া জরুরি। নদীশাসনের মধ্য দিয়ে চরগুলোতে সুড়ঙ্গ করা গেলে দেশের কৃষিতে বড় অবদান রাখা সম্ভব। বর্তমান বৈশ্বিক এ সংকটে খাদ্য উৎপাদনের বড় জোগান হতে পারে দেশের উত্তরের চরাগুলো।

নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ১৭৮৭ সালে ভয়াবহ বন্যার সময় তিস্তা নদীর প্রবাহের সৃষ্টি। ২৩৫ বছর আগে তৈরি হওয়া এ নদীর আজ অবধি কোনো পরিচর্যা করা হয়নি। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান পর্ব ও বাংলাদেশ যুগের কোনো সময়েই এ নদীর সঠিক পরিচর্যা হয়নি। বরং দফায় দফায় এ নদীর সর্বনাশ করার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে যে নদী হয়ে ওঠার কথা ছিল উত্তরের জীবনরেখা, সেটা হয়ে উঠেছে অভিশাপ। নদীকে যদি আমরা অভিশাপের হাত থেকে আশীর্বাদে পরিণত করতে চাই, তাহলে এ তিস্তা নদীর সুরক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজন।

নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠনের বক্তব্য

জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদীর পানি ও পলি দিয়ে গঠিত বাংলাদেশ আজ পানির অভাবে মরুকরণের হুমকির মুখে। কিন্তু এ পানির অভাব প্রাকৃতিক কারণে নয়। চীন, নেপাল, ভুটান ও ভারত থেকে আসা নদীগুলো বাংলাদেশের প্রাণপ্রবাহ। কিন্তু আন্তর্জাতিক সব নীতি লঙ্ঘন করে ৫৪টি নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে ভারতের পানি সরিয়ে নেওয়ার আগ্রাসী তৎপরতার ফলে পানিপ্রবাহ কমেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নদীর দখল-দূষণ। একসময় দেশের এক হাজার ২০০ নদী ছিল। সরকারগুলোর ভ্রান্তনীতি ও দখল-দূষণের কারণে নদীর সংখ্যা এখন ২৩০-এ নেমে এসেছে। খরা মৌসুমে বেশির ভাগ নদীতে পানি থাকে না। একসময়ের তিস্তার মতো প্রমত্তা অনেক নদী এখন খালে পরিণত হয়েছে।

তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, ভারত থেকে ধেয়ে আসা উজানের ঢলে রংপুর অঞ্চলের তিস্তা অববাহিকায় প্রায়ই অসময়ে বন্যা হচ্ছে। বন্যা ও নদীভাঙনের ভয়াবহতায় এ অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি হুমকির মুখে। খরাকালে গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে শুকনো মৌসুমে পানি আটকে রাখে ভারত। আবার একটু পানি বেশি হলেই বাংলাদেশকে কিছু না জানিয়ে গজলডোবার গজবে ভাসাচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষদের। এতে প্রতি বছর ব্যাপক ফসলহানি ঘটছে। হুমকিতে পড়ছে খাদ্য-নিরাপত্তা। নদীভাঙনে বাড়ছে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা, বাড়ছে রংপুর বিভাগে গড় দারিদ্র্যের হার।

তিনি আরও বলেন, আন্তঃদেশীয় ব্যবস্থাপনায় তিস্তা অববাহিকার ভারত-বাংলাদেশ মিলে নদী ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে না পারা এবং দেশীয় ব্যবস্থাপনায় নদী খনন, ভাঙন রোধে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে না পারায় তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশের ১১৫ কিলোমিটারে বসবাসরত দুই কোটি মানুষের জীবনে মহাদুর্যোগ নেমে এসেছে। অথচ তিস্তাকে ঘিরে এ অঞ্চলের কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা চলে। তিস্তা যদি আরও মরে যায় তাহলে কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। এ অঞ্চলে পাঁচজন মন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তিস্তা নিয়ে সংসদে জোর আওয়াজ তোলা হচ্ছে না।

তিস্তা নদী এ অঞ্চলের মানুষের জীবনসঞ্চারী। তিস্তার অব্যাহত ভাঙনে দুই পাড়ের মানুষের জীবন, সম্পদ ও কৃষিজমি সব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ দুরবস্থা লাঘবে তিস্তা নদী বিজ্ঞানসম্মতভাবে সুরক্ষা জরুরি। দুই কিলোমিটার প্রস্থের নদী এখন ১০-১২ কিলোমিটারে পরিণত হয়েছে। ভাঙন, বন্যা ও খরার হাত থেকে এ অঞ্চলের মানুষকে রক্ষায় তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা জরুরি। বিদেশি অর্থসহায়তা না মিললে পদ্মা সেতুর মতো দেশের টাকায় তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন কত দূর

প্রতি বছর বন্যার কারণে তিস্তাপাড়ের হাজার হাজার মানুষের ঘরবাড়িসহ আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এতে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন তিস্তাপাড়ে মানুষ। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে তিস্তাপাড়ের মানুষগুলো আলোর মুখ দেখবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। গত বছরের ৯ অক্টোবর লালমনিরহাটের তিস্তা ব্যারাজ ও নীলফামারীর কমান্ড এলাকা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা জানান।

চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, অর্থনীতি, প্রকৃতি ও পরিবেশ যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সর্বোপরি অত্র এলাকার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যারাজ এলাকার সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে এবং দুই দেশের সরকারের প্রচেষ্টায় দ্রুত কাজ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

‘তিস্তাপাড়ের মানুষগুলো কী চান সেটা আগে লক্ষ্য করা হচ্ছে। যেহেতু তিস্তা আন্তর্জাতিক নদী সেই কারণে লাভ ও ক্ষতি কী রকম হচ্ছে সেটিও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।’

এদিকে, চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং তিস্তা নদী এলাকা পরিদর্শন করার পরের দিন (১০ অক্টোবর) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, এখনও অফিশিয়াল কোনো তথ্য পাইনি। তবে, আপনাদের (গণমাধ্যম) মাধ্যমে আমরা শুনতে পাচ্ছি। তিস্তা নিয়ে আমরা ১২ বছর দেনদরবারে আছি। পুরোনো প্রস্তাবটা তারা (চীন) আবার নতুন করে দিয়েছে। এটাতে তারা (চীন) আর্থিক সাহায্য করতে পারে।

তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের ইতিহাস টেনে ড. মোমেন বলেন, আমরা শুনেছি ১৯৮৮-৮৯ সালে বাংলাদেশে পরপর বড় রকমের বন্যা হয়। তখন ফ্রান্সের একটি দল বাংলাদেশে এসেছিল তৎকালীন প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে। তখন তারা একটি প্রজেক্ট কীভাবে বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়; এর ওপর একটা কমপ্রিহেনসিভ স্টাডি করে। সেই স্টাডিতে তারা তিস্তার কথা বলেছে। তখন এটা অনেক টাকা-পয়সার কারণে হাতে নেওয়া হয়নি।

এদিকে, নাম না প্রকাশের শর্তে রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করার কথা রয়েছে চীনা প্রকৌশলীদের। তাদের একটি প্রতিনিধি দল ডালিয়া ব্যারাজ ও তিস্তা নদীর বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করেছে। বর্তমানে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে আটকে আছে। প্রকল্পে অর্থায়ন কে করবে, বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়ায় ফাইল পরিকল্পনা কমিশনের লাল ফিতাতে বন্দি আছে।

উজানে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে নতুন উৎকণ্ঠা

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তা নদীর পানি এ দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক এ নদীর পানির ন্যায্য পাওনা নিশ্চিতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ। সেটা খুব একটা সফল হয়নি। এবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সরকার এ নদীর একটি উপ-নদীতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এছাড়া তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের আওতায় আরও দুটি খাল খননের জন্য প্রায় এক হাজার একর পরিমাণ জমির মালিকানা পেয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের সেচ বিভাগ। কৃষিকাজের জন্য তিস্তা থেকে পানি সরিয়ে নিতে সেচ বিভাগকে এ জমির মালিকানা দিয়েছে রাজ্য সরকার।

পশ্চিমবঙ্গের এ পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। কারণ, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির জন্য এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে তিস্তার উজানে ভারতের জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্তে নতুন করে উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছে।

ভারতের এ সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশের কৃষি ও প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র মনে করছেন বাসদ (মার্কসবাদী) নেতারা। রংপুর জেলার আহ্বায়ক আনোয়ার বাবলু বলেন, সরকারের নতজানু নীতির কারণে বাংলাদেশের মানুষ এখনও নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত। উপরন্তু ভারত সরকার সাম্প্রতিক সময়ে তিস্তার উজানে জলপাইগুড়িতে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে তিস্তা মরে যাবে, উত্তরাঞ্চলের সেচ ব্যবস্থা চরম হুমকির মুখে পড়বে। এছাড়া এ অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতিও ধ্বংসের সম্মুখীন হবে।

এমজেইউ