বর্ষার পানিতে ফুলেফেঁপে ওঠা তিস্তা এখন পানির অভাবে ধু ধু বালুচর। নদীর পাড়ে নেই নৌকা, মাঝি-মাল্লাদের হাঁকডাক। নেই জেলেদের মাছ ধরার ব্যস্ততা। এ যেন নিরাশার বালুচরে থমকে গেছে তিস্তাপাড়ের জীবন-জীবিকা।

বর্ষায় বন্যা আর ভাঙনের মুখে পড়তে হয় তিস্তাপাড়ের বাসিন্দাদের। ভাঙন ও প্রবল স্রোতে ভেসে যায় ফসলি জমি ও বসতভিটা। আর বর্ষা শেষ হতেই পানি শুকিয়ে তিস্তার বুকে জেগে ওঠে ধু ধু বালুচর। ভারতের একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণের কারণে তিস্তা নদীর এ করুণ দশা। ফলে হুমকির মুখে তিস্তা অববাহিকায় জীববৈচিত্র্য।

এদিকে, তিস্তার পানি আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় রংপুর অঞ্চলের ৪৯ হাজার হেক্টর জমি সেচ প্রকল্পের বাইরে রয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ব্যারাজের বেশ কয়েকটি ক্যানেলের উন্নয়নমূলক কাজ চলমান। তাই ক্যানেলগুলোতে এ বছর পানি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে, আগামী মৌসুম থেকে প্রকল্প এলাকায় সেচের জমির পরিমাণ আরও বাড়বে।

বিগত বছরগুলোর মতো এবারও তিস্তার পানি দিয়ে শতভাগ সেচ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। চলতি বোরো মৌসুমে অনেক জমিতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কৃষকদের সেচ দিতে হচ্ছে। এতে চারা রোপণ ও বপন থেকে ফসল উৎপাদন পর্যন্ত বাড়তি ব্যয় গুনতে হচ্ছে কৃষকদের। সেচ প্রকল্প এলাকায় ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদানের কথা থাকলেও এ বছর সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে। ফলে সেচ প্রকল্পের বাইরে রয়েছে ৪৯ হাজার হেক্টর জমি

ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর নীলফামারীর ডিমলা-খড়িবাড়ি সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। এরপর নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে এ নদী। ভারতের গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ভারত সরকার একতরফা তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণ করায় শীতে বাংলাদেশ অংশে প্রায় মরুভূমিতে পরিণত হয়। বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানির প্রবাহের ফলে বাংলাদেশ অংশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত বছরগুলোর মতো এবারও তিস্তার পানি দিয়ে শতভাগ সেচ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। চলতি বোরো মৌসুমে অনেক জমিতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কৃষকদের সেচ দিতে হচ্ছে। এতে চারা রোপণ ও বপন থেকে ফসল উৎপাদন পর্যন্ত বাড়তি ব্যয় গুনতে হচ্ছে কৃষকদের। সেচ প্রকল্প এলাকায় ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদানের কথা থাকলেও এ বছর সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে। ফলে সেচ প্রকল্পের বাইরে রয়েছে ৪৯ হাজার হেক্টর জমি।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সেচ প্রকল্পের আওতায় ২০১৪ সালে বোরো মৌসুমে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু সেই বছর সেচ দেওয়া সম্ভব হয় মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সেচ দেওয়া হয় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৭ সালে মাত্র আট হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে ৩৫ হাজার হেক্টর, ২০১৯ ও ২০২০ সালে তা বেড়ে ৪০ হাজার হেক্টরে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২১-২০২২ সালে ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা হয়। তবে, এবার তা কমে ৩৫ হাজার হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে নীলফামারীর ডোমার, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর, নীলফামারী সদর মিলে ২৫ হাজার হেক্টর জমি, রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় সাত হাজার হেক্টর জমি এবং দিনাজপুরের খানসামা ও চিরিরবন্দর উপজেলায় তিন হাজার হেক্টর জমি।

তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রকল্প এলাকায় সেচ দেওয়া এবং নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে স্বাভাবিক প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি। শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন প্রায় ১৪ হাজার কিউসেক এবং নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন ছয় হাজার কিউসেক পানি। কিন্তু শুকনো মৌসুমে তিস্তায় প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যায় না। এ মৌসুমে বোরো আবাদের সময় ব্যারাজ পয়েন্টে বিগত কয়েক বছর ধরে পাওয়া যায় মাত্র দুই থেকে তিন হাজার কিউসেক পানি। যে সামান্য পরিমাণ পানি তিস্তা নদীতে পাওয়া যায় তার সবটুকুই সেচের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের সেচ খালের মাধ্যমে কৃষিজমিতে সরবরাহ করা হচ্ছে। ব্যারাজের ৪৪টি গেট বন্ধ রেখে সেচ প্রকল্পে পানি সরবরাহ করায় মূল নদীতে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে নদী ধু ধু বালু চরে পরিণত হয়েছে।

নদীর পাড়ের জেলেরা জানিয়েছেন, একসময় তিস্তায় প্রচুর মাছ ধরা পড়ত। সেই মাছ বিক্রি করেই তারা সংসার চালাতেন। কিন্তু বর্তমানে পানিশূন্য তিস্তায় মাছের আকাল পড়েছে। অনেক জেলে পেশা পরিবর্তন করেছেন। যারা রয়েছেন তাদের সংসার চলে অনাহারে-অর্ধাহারে।

তিস্তা ব্যারাজ এলাকার জেলে মনির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখন পানি নেই, মাছও নেই। সংসার চালানো খুব মুশকিল হয়ে গেছে। কী করব, রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা পইড়া থাকি দুজন মানুষ। তারপরও ২০০-৩০০ টাকা কইরা ভাগে পাই না। মাছ না পেয়ে অনেকে এখান থেকে বাড়ি চলে গেছে। নদীতে এখন যদি পানি থাকত তাহলে ভালো হতো। পানি চলাচল থাকলে মাছ পেতাম। যেখানে এক বুক পানি থাকার কথা সেখানে এখন ধু ধু বালুচর।’

সেচ প্রকল্পের আওতায় ২০১৪ সালে বোরো মৌসুমে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু সেই বছর সেচ দেওয়া সম্ভব হয় মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সেচ দেওয়া হয় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৭ সালে মাত্র আট হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে ৩৫ হাজার হেক্টর, ২০১৯ ও ২০২০ সালে তা বেড়ে ৪০ হাজার হেক্টরে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২১-২০২২ সালে ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা হয়। তবে, এবার তা কমে ৩৫ হাজার হেক্টরে দাঁড়িয়েছে

এমদাদুল হক নামের আরেক জেলে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে এ সময় নদীতে অনেক পানি থাকত। কিন্তু এখন তো নদী শুকিয়ে গেছে, মাছ নেই। অনেক কষ্টে সংসার চলে।

ডিমলার টেপাখড়িবাড়ি এলাকার সামসুল হক বলেন, শুষ্ক মৌসুমে যখন চাষাবাদের জন্য পানির প্রয়োজন তখন তিস্তায় পানি পাই না। ভারত বন্ধ করে দেয়। যখন পানির দরকার নেই তখন পানি ছেড়ে আমাদের ফসল-বাড়িঘর সব ভাসিয়ে দেয়।

একই এলাকার হামিদা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার শ্বশুরের ১০০ বিঘা সম্পত্তি গেছে এ নদীতে। এখনও ভাঙতেছে। সরকারের কাছে একটাই দাবি, নদীটা ভালো করে বাঁধুক। আমরা ১০ কেজি, পাঁচ কেজি চালের আশায় বসে থাকি না। আল্লাহ আমাদের হাত দিছে কর্ম করে খেতে পারব।’

নাউতরা শালহাটি গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলম বলেন, গত বছর তিস্তার সেচ প্রকল্পের পানি দিয়ে ১০ বিঘা জমিতে বোরো রোপণ করেছিলাম। কিন্তু এ বছর ক্যানেলের পানি দিয়ে তিন বিঘা জমিতে আবাদ করতে পেরেছি। বাকি জমিগুলো ডিজেলচালিত নলকূপ দিয়ে চারা রোপণ করতে হয়েছে। এতে খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এবার মনে হয় খরচই তুলতে পারব না।

একই গ্রামের শাহিনুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘হামরা ক্যানেলের পানিত প্রতিবারে আবাদ করি আইসেছি। শ্যালো দিয়া আবাদ করলে খরচ বেশি পড়ি যায়। ক্যানেলের পানিতে ফলনও ভালো হয়। কিন্তু এবার ক্যানেলের পানিত আবাদ করির পাই নাই। শ্যালো দিয়া আবাদ করছি, মেলা খরচ হয়া গেইছে।’

নীলফামারী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. এস এম আবু বকর সাইফুল ইসলাম বলেন, জেলায় তিস্তা ক্যানেলের আওতায় ২৭৯টি আউটলেটে মোট ১০ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমি। প্রত্যেক সেচ মৌসুমে এ জেলার বেশির ভাগ কৃষকই নিজস্ব অর্থায়নে শ্যালোমেশিনসহ বিভিন্ন উপায়ে নিজেদের জমিতে সেচ প্রদানের মাধ্যমে চাষাবাদ করছেন।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদৌলা ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিস্তা নদীর উজানে ও ভাটিতে চর পড়েছে। চর পড়ার কারণে কিন্তু নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে নদীর দুই তীরে ভাঙন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেচ প্রকল্পের পানি যা আছে তা রোটেশন করে আমাদের ক্যানেলগুলোতে দিয়ে দিচ্ছি। আমাদের যতটুকু পানি আছে, এ বছর টার্গেট রয়েছে ৩৫ হাজার হেক্টর জমি। আমরা কিন্তু পুরো জমিতেই সেচ দিয়েছি। বাকি সময়টা আশা করছি যে পানি রয়েছে তা দিয়ে সেচ কাজ শেষ করতে পারব।

তিনি আরও বলেন, পানি কম থাকলেও রোটেশন করে পানি দেওয়া হচ্ছে। কোনো সমস্যা হচ্ছে না। নদীতে চর পড়ার কারণে ধারণক্ষমতা কমে গেছে। নদী ড্রেজিং করলে ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এ লক্ষ্যে বর্তমানে একটি ব্যারাজের উজানে রিজার্ভার করার স্টাডি শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এর প্রতিবেদন পেলে আমরা ডিপিপি সাবমিট করতে পারব। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আমাদের পানির যে চাহিদা রয়েছে তা পূরণ করা সম্ভব।

এমজেইউ