ঐতিহাসিক ২৮ মার্চ স্মরণে রংপুর নিসবেতগঞ্জে রক্ত গৌরব স্মৃতি স্মারক

আজ ২৮ মার্চ, ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস। আজকের দিনটি রংপুরের মানুষের জন্য স্মরণীয় ও বীরত্ব গাঁথার দিন। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই দিনে বাঁশের লাঠি, তীর-ধনুক, দা-কুড়াল, বল্লম নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে এক অনন্য ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল অকুতোভয় বীর বাঙালি।

যথাযথ মর্যাদায় রংপুরের ঐতিহাসিক ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস পালন করা হবে। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫২ বছর পার হলেও এখনো জাতীয়ভাবে সেদিনের স্বীকৃতি মেলেনি। অথচ বাঁশের লাঠি, তীর-ধনুক, দা-কুড়াল, বল্লম নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করার নজির বিশ্বে আর কোনো দেশে নেই। এটি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সাহসিকতার এক বিরল ঘটনা।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র একদিন পরই স্বাধীনতার জন্য মুখিয়ে থাকা রংপুরবাসী পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি ‘ক্যান্টনমেন্ট’ ঘেরাও করে। সেই দিনের বীরত্বগাঁথা, সাহস আর আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণার পথ ধরেই সূচিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রাম।

রংপুরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর শাসন, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিল। ৩ মার্চ রংপুরে মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন কিশোর শংকু সমজদার। স্বাধীনতার গণআন্দোলন সংগ্রামের প্রথম ‌‘শহীদ’ বলা হয় শংকু সমজদারকে। ২৪ মার্চ নিসবেতগঞ্জ এলাকাতে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি জিপ গাড়িতে হামলা করে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে আব্বাসী নামে সেনা সদস্যকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে স্থানীয় শাহেদ আলী নামে এক কসাই। এ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গোটা শহরে। বাড়তে থাকে পাকসেনাদের ক্রোধ আর প্রতিশোধের মহড়া।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর দেশের মানুষ প্রস্তুতি গ্রহণ করে সশস্ত্র সংগ্রামের। এরই অংশ হিসেবে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও এর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এখানকার স্বাধীনতাকামী মানুষেরা। দিনক্ষণ ঠিক হয় ২৮ মার্চ। ঘেরাও অভিযানে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিভিন্ন হাট-বাজারে ঢোল পেটানো হয়। এ আহ্বানে অভূতপূর্ব সাড়া মেলে। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার সাজ সাজ রব পড়ে যায় চারিদিকে।

যার যা আছে তাই নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেয় ছাত্র, কৃষক, দিনমজুরসহ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল পেশার সংগ্রামী মানুষ। রংপুরের আদিবাসীরাও তীর-ধনুক নিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকে। এক্ষেত্রে মিঠাপুকুর উপজেলার ওরাঁও সম্প্রদায়ের তীরন্দাজ সাঁওতালদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। সেদিন তীর-ধনুক, বল্লম, দা, বর্শা নিয়ে তারা যোগ দিয়েছিল ঘেরাও ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণে।

১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ রোববার ছিল। সেদিন সকাল থেকে রংপুরের বিভিন্ন এলাকার মানুষ সংগঠিত হতে থাকে। সময় যত গড়াতে থাকে উত্তাপ আর উত্তেজনা যেন ততই বাড়তে থাকে। বেলা ১১টা বাজতে না বাজতেই সাজ সাজ রব পড়ে যায় চারিদিকে। জেলার মিঠাপুকুর, বলদিপুকুর, ভূরারঘাট মানজাই, রানীপুকুর, তামপাট, পালিচড়া, বুড়িরহাট, গঙ্গাচড়া, শ্যামপুর, দমদমা, লালবাগ, গনেশপুর, দামোদরপুর, পাগলাপীর, সাহেবগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হতে থাকে। সবার হাতে লাঠি-সোটা, তীর-ধনুক, বর্শা, বল্লম, দা ও কুড়াল।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং সে সময় রংপুর ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ২৯ ক্যাভেলরী রেজিমেন্টের মেজর নাসির উদ্দিন তার ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’ গ্রন্থে সে দিনের বর্ণনায় লিখেছেন, ‘যে দৃশ্য আমি দেখলাম তা চমকে যাওয়ার মতোই। দক্ষিণ দিক থেকে হাজার হাজার মানুষ সারি বেধে এগিয়ে আসছে সেনা ছাউনির দিকে। তাদের প্রত্যেকের হাতেই দা-কাঁচি, তীর-ধনুক, বর্শা, বল্লমের মতো অতি সাধারণ সব অস্ত্র।

বেশ বোঝা যাচ্ছিল এরা সবাই স্থানীয়। সারি বাধা মানুষ পিঁপড়ার মতো লাঠি-সোঠা বল্লম হাতে ক্রমেই এগিয়ে আসছে ক্যান্টনমেন্টের দিকে। এ সময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে গোটা দশেক জিপ বেরিয়ে আসে এবং মিছিল লক্ষ্য করে শুরু হয় একটানা মেশিনগানের গুলি বর্ষণ। মাত্র ৫ মিনিটে চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার মরদেহ পড়ে থাকে মাঠে।

গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে টেনে হিঁচড়ে এনে এক জায়গায় জড়ো করা হলো পুড়িয়ে ফেলার জন্য। কিন্তু তখনো যারা বেঁচে ছিল তাদের গোঙ্গানিতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল পাঞ্জাবি জান্তারা। এ অবস্থাকে আয়ত্তে আনার জন্য বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে চিরতরে তাদের থামিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।’

তিনি বর্ণনা করেছেন, ‘আহতদের আর্তনাদে গোটা এলাকার আকাশ বাতাস যেন ভারি হয়ে উঠল। সেদিন সন্ধ্যার আগেই নির্দেশ মতো ৫ থেকে ৬শ মরদেহ পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। এ আগুন অন্য যে কোনো আগুনের চেয়ে অনেক বেশি লাল। অনেক বেশি দহন করে এই বহিঃশিখা। খুব কাছ থেকেই সেই আগুন আমি দেখছি। দেখছি কেমন করে জ্বলছে স্বাধীনতাপ্রিয় অসহায় মানব সন্তান।’

সেদিনের ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণে অংশ নেন একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান মাস্টার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু এই তিনটি স্লোগানকে বুকে ধারণ করে ২৮ মার্চ হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষকে সঙ্গে নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে গিয়েছিলাম। সে সময় পাক হানাদারের গুলিতে অসংখ্য বাঙালি শহীদ হন।

তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে ৬ নম্বর সেক্টরে থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। পহেলা এপ্রিল সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন আনোয়ারের নেতৃত্বে ৩ শতাধিক আনসার, পুলিশ ও সেনা সদস্য বদরগঞ্জে আসেন। সেই বহরে আমিও অংশ নিয়ে বদরগঞ্জ থেকে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে গিয়েছিলাম। সেখানে তাদের গ্রেনেড দিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার প্রশিক্ষণ শুরু গ্রহণ করি। আজও চোখের সামনে ২৮ মার্চের ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের ছবি ভেসে ওঠে।

আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মুক্তির নেশায় পাগল এসব মানুষদের সংগঠিত করেন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সিদ্দিক হোসেন এমপি, আব্দুল গণি, তৈয়বুর রহমান, মুখতার এলাহি, আবুল মনছুর, ইছহাক চৌধুরী, ন্যাপ নেতা সামছুজ্জামান ও কমিউনিস্ট নেতা ছয়ের উদ্দিনসহ আরও অনেকে। সেদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা গ্রামের হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ তীর-ধনুক, দা-কুড়াল, বল্লম ও বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের আশপাশের এলাকাসহ ঘাঘট নদীর তীরে জমায়েত হয়। শুরু হয় পাক সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ লড়াই।

ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ওরাঁও সম্প্রদায়ের তীরন্দাজ সাঁওতালরা এই আক্রমণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে তারা রংপুর ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসতে থাকে বৃষ্টির মতো গুলি। গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানেই শহীদ হন হাজারেরও বেশি মানুষ। সেদিন এই সম্মুখযুদ্ধে নাম জানা, অজানা অনেক নিরস্ত্র মানুষ পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন। আহত হন অগণিত। এখন এসব শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের খোঁজ রাখে না কেউ। অনেক আহত ব্যক্তি পঙ্গুত্ববরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

২৮ মার্চ ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে গিয়ে শহীদ হন মিঠাপুকুরের রাণীপুকুর ইউনিয়নের দৌলত নূরপুর গ্রামের আয়নাল হক। তার স্ত্রী রওশনা বেগম জানান, বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি তীর-ধনুক নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে গিয়ে পাকসেনাদের গুলিতে ঘটনাস্থলেই তার স্বামী (আয়নাল) মারা যান। পরদিন কয়েকজন প্রতিবেশী কাঁধে করে আয়নালের মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসে।

একই ইউনিয়নের নাসিরাবাদ গ্রামের মৃত মমদেল হোসেনের ছেলে মনছুর আলী ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে গিয়ে পাকসেনাদের গুলিতে পঙ্গুত্ববরণ করেন। বর্তমানে অন্যের ওপর নির্ভর করে চলছে তার সংসার। মনছুর আলী বলেন, দেশকে হানাদারমুক্ত করতে পাকসেনাদের ঘাঁটি দখল করতে ক্যান্টনমেন্ট গিয়েছিলাম। আমাদের হাতে ছিল তীর-ধনুক আর বুকে ছিল দেশ স্বাধীন করার মনোবল। গুলিবিদ্ধ হয়ে আমি সেখান থেকে কোনো রকমে জীবন নিয়ে ফিরে আসি। সেদিন অনেকে শহীদ হয়েছিল। এখন আমাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার মতো কেউ নেই। স্বাধীনতার এতো বছর হয়ে গেল তবুও স্বীকৃতি মিলল না।

প্রতি বছর রংপুর জেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় এলাকাবাসীর উদ্যোগে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পালিত হয় ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস। এদিনে নিসবেতগঞ্জে ‘রক্ত গৌরব’ স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

২৮ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ তথা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এটাই ছিল মুখোমুখি প্রথম যুদ্ধ। কিন্তু সেদিনের হাজার হাজার দেশপ্রেমী জনতার আত্মত্যাগের স্বীকৃতি আজও মিলেনি। প্রতি বছর ২৮ মার্চ এলে কিছু অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে এসব বীর শহীদদের আত্মত্যাগ। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন শহীদ পরিবারগুলো।  

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে