মহাসড়ক কেড়ে নেয় নুরল ইসলামের বাড়ি, মেয়ে নেয় টাকা

চাকরি জীবনের শেষ সম্বলটুকু ছেলে-মেয়েদের দিয়ে নিজেই এখন অসহায় পড়েছেন নুরল ইসলাম (৯৭)। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এই অশীতিপরের ছেলে-মেয়ে থাকলেও যাত্রীছাউনিই এখন তার শেষ আশ্রয়স্থল। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে আশ্রয় হয় মেয়ের বাড়িতে।

তার জমানো টাকা আত্মসাৎ করে মেয়েও তাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। অন্যের দেওয়া খাবার খেয়ে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে যাত্রী ছাউনিতে শুয়ে দিন কাটছে তার।

নুরল ইসলামের জন্ম হিন্দু পরিবারে। সেই সময় তার নাম ছিল বাবুলাল। বাবার নাম ছিল সিন্ধুলাল। ১৯৯০ সালে নভেম্বর মাসে আদালতের মাধ্যমে স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তিনি।

১৯২৪ সালে ঢাকা শহরের সূত্রাপুর থানার ওয়ারি এলাকায় তার জন্ম। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে আর এগোতে পারেননি তিনি।
 
শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে যাত্রীছাউনিতে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরের মেঝেতে ছেঁড়া কাথায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন নুরল ইসলাম। কেঁদে কেঁদে যেন চোখের পানি ফুরিয়ে গেছে। পাশেই ময়লাযুক্ত একটি লেপ আর ছেঁড়া বালিশ। সামনের দিকে একটি শুকনো পাউরুটি, একটি পানির বোতল রয়েছে। সারাশরীর কাঁপছে তার। বার বার কোনো একজনকে ডেকে কী যেন বলছেন আর কাঁদছেন। 

সেখানেই বসে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় নুরল ইসলামের। তিনি বলেন, তার পূর্বপুরুষরা হিন্দু ধর্মের ছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর অভাবের কারণে কুষ্টিয়ায় যান তিনি। পরে নব্বইয়ের দশকে তিনি দিনাজপুরের জয়নগর এলাকায় চলে আসেন।

জীবনের স্মৃতির কথাগুলো বলতে বলতে বার বার কেঁদে ফেলছেন। নুরল ইসলাম বলেন, কুষ্টিয়ায় যাওয়ার পর হিন্দু ধর্মের এক মেয়েকে বিয়ে করেন। পরে দিনাজপুরে এসে আদালতের মাধ্যমে হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সেই সময় কোর্টের ম্যজিস্ট্রেট ছিলেন কিরণ বাবু।

তিনি আরও বলেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর আমার নাম হয় নুরল ইসলাম। দিনাজপুর পল্লীবিদ্যুৎ-২ অফিসে ঝাড়ুদার হিসেবে চাকরি নেন তিনি। অফিস থেকে পাশের জয়নগর বাজারে সড়ক ও জনপদ (সওজ) বিভাগের জমিতে একটি ঝুপড়িঘর তুলে কোনোমতে চলছিল তার সংসার।

নুরল ইসলাম বলেন, ১৫ বছর ঝাড়ুদারের চাকুরি শেষে অবসরের শেষ সম্বলটুকু তুলে দেন ছেলে ইউসুফ আলী ‍ও মেয়ে রিনা বেগম হাতে। কয়েক বছর ভালোয় চলছিল তার। বছর তিনেক আগে প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হন তিনি। গেল দেড় বছর আগে তার স্ত্রী মারা যান।

এদিকে দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ মহাসড়ক প্রশস্তকরণের কাজ শুরু হলে তার বাড়িটিও ভাঙা পড়ে। পরে অসুস্থ অবস্থায় তার ঠাঁই মেলে মেয়ে রিনা বেগমের বাড়িতে।

তিনি আরও বলেন, সরকারি সহায়তা বয়স্কভাতার কার্ডের টাকাগুলোও আমার মেয়ে আত্মসাৎ করে আমাকে একটি ভ্যানযোগে জয়নগর বাজারে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন আমাকে দেখার মতো কেই নেই। স্থানীয়রা এই যাত্রীছাউনিতেই এনে দিয়েছে। এখন এটাই আমার শেষ ঠিকানা। কেউ খাবার দিলে খাওয়া হয়, না দিলে নেই। হাঁটতে পারিনা। টয়লেট করতে পারি না। একটি হুইল চেয়ার খুব প্রয়োজন।

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘৯৭ বছর বয়সেও মোক আল্লাহ তুলে নেয় না কেন? বাঁচার ইচ্ছে আর নাই। মোর মরণ ভালো।’

স্থানীয় বাজারের গ্রিল ব্যবসায়ী মশিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নুরল ইসলাম এখন অসহায় হয়ে পড়েছেন। তাকে দেখার মতো কেউ নেই। ছেলে-মেয়ে থাকলেও তারা কোনো খোঁজ করে না। বাজারের মানুষ তাকে যেটুকু দেন তাতেই খেয়ে না খেয়ে আছেন তিনি। সারাদিন কান্না করেন। তাকে সরকারি সহায়তার বাড়ি দিলেও একটা ঠাঁই হয়।

ফুলবাড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মিল্টন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নুরল ইসলামের অসহায়ের বিষয়টি আমি শুনেছি।আসলে ছেলে-মেয়ে থেকেও নেই। তার বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রিয়াজ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, উনার বিষয়ে আগে আমার জানা ছিল না। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

দিনাজপুর জেলা প্রশাসক খালেদ মোহাম্মদ জাকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, নুরল ইসলামের বিষয়টি আসলেই অমানবিক। তার বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে দ্রুতই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ঘর পাওয়ার যোগ্য হলে সেটিরও ব্যবস্থা করা হবে।

দিনাজপুর-৬ আসনের এমপি শিবলী সাদিক বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে কোনো মানুষ না খেয়ে থাকার কথা নয়। নুরল ইসলামের কেন এমন অবস্থা আমার জানা নেই। আমার পক্ষ থেকে আগামীকালের মধ্যেই তাকে একটি হুইল চেয়ার প্রদান করা হবে।’

এমএসআর