শিশুদের চিকিৎসা দিচ্ছেন ডা. অসীম কুমার সাহা

একটি শিশুর জন্মের পরে ছোট-বড় যেকোনো সমস্যায় বাবা-মা প্রথমেই দৌড়ান চিকিৎসকের কাছে। আর সেই চিকিৎসক যদি হন সেরা একজন শিশু বিশেষজ্ঞ, তাহলে তো মা-বাবার ভরসা যায় বেড়ে। কেবল একজন শিশু বিশেষজ্ঞই নন, সেবামূলক কাজের মাধ্যমে যিনি ইতোমধ্যে নিজের নামটি জুড়ে দিয়েছেন বিভিন্ন স্তরে।

ঝালকাঠি জেলার যেকোনো পরিবার নবজাতক ও শিশুদের জন্মের পর একবার হলেও যে বিশেষজ্ঞের কাছে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়, তিনি হলেন অধ্যাপক ডা. অসীম কুমার সাহা। করোনা পরিস্থিতিতেও এক দিনের জন্য বন্ধ রাখেননি শিশু চিকিৎসা। ঝালকাঠির শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া অব্যাহত রেখেছেন তিনি।

শিশুদের চিকিৎসায় গত ৩৪ বছর ঝালকাঠিসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের ভরসা ডা. অসীম কুমার সাহা। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু বিভাগের প্রধান থাকাকালীন অবসরে যান তিনি। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি থেকে এফআরসিপি সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে তাকে। আন্তর্জাতিক এই সনদ পাওয়া শিশু বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি এ সম্মাননা অর্জন করলেন।

ডা. অসীমের বর্ণাঢ্য কর্মজীবন, শিক্ষাজীবন, শিশুবিষয়ক ডিসিপ্লিনে আসার অনুপ্রেরণা ও তার প্রতিষ্ঠিত ‘অসীমাঞ্জলী ফাউন্ডেশন’-এর কর্মকাণ্ড তুলে ধরেছে ঢাকা পোস্ট।

ডা. অসীম কুমার সাহা

ডা. অসীমের বাবা অক্ষয় কুমার সাহা ঝালকাঠিতে একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। অক্ষয় কুমারের ১১ সন্তানের মধ্যে ডা. অসীম নবম। প্রাতিষ্ঠানিক শিশু শ্রেণির পাঠ শুরু করেন ঝালকাঠির মসজিদ বাড়ি স্কুলে। এরপর পৌর আদর্শ বিদ্যালয়ে পড়েন। মাধ্যমিক পাস করেন ঝালকাঠি সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৭৬ সালে এবং তার কেন্দ্রে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর ১৯৭৮ সালে আবারও কেন্দ্রে প্রথম হিসেবে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন ঝালকাঠি মহাবিদ্যালয় থেকে। ১৯৮৫ সালের জানুয়ারি মাসে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।

এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড ফিজিকস অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। এর আগেও তিনি ক্লাসের প্রতিটি পরীক্ষাতেই প্রথম হয়েছেন।

এমবিবিএস পাস করার পর চাকরি নিয়ে বরিশাল অঞ্চলেই ফিরে আসেন। প্রথমে বরিশালের উজিরপুরের একটি ইউনিয়নে সাব-সেন্টারে দায়িত্ব পালন করেন ১ বছর ১০ মাস সময়। রাজাপুর ও নলছিটিসহ ঝালকাঠির পার্শ্ববর্তী এলাকায় আরও কয়েক বছর চাকরি করেন।

পরে যখন তার মনে হলো শিশু বিষয়ে আরও উচ্চশিক্ষা অর্জন করা দরকার, তখন ১৯৯৪ সালে তৎকালীন আইপিজিএম বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এফসিপিএস কোর্সে ভর্তি হন। প্রথম পর্ব শেষ করে দ্বিতীয় পর্বের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগে। দ্বিতীয় পর্ব পাস করতে দেরি হওয়ায় ওই সময়ের মধ্যে ডিসিএইচ এবং এমসিপিএইচ দুটি ডিগ্রি অর্জন করেন। এফসিপিএস দ্বিতীয় পর্ব শেষ করেই শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজেই রেজিস্ট্রার হিসেবে পোস্টিং হয় তার। পরবর্তী সময়ে কনসালট্যান্ট নিযুক্ত হন।

ঝালকাঠি শহরে ডা. অসীম রোগীদের সেবা দেওয়া শুরু করেছিলেন ১৯৮৮ সালে খান মেডিকেল হাউসে চাকরির মধ্য দিয়ে। হাউসটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে নিজস্ব চেম্বার চালু করেন তিনি। তারপর ২০০৯ সালে শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর সহযোগী অধ্যাপক ও পরে অধ্যাপক হন। সর্বশেষ বিভাগীয় প্রধান হিসেবে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে অবসর নেন।

ঢাকা পোস্টকে ডা. অসীম বলেন, আমি যে শিশুকে দেখি বা চিকিৎসা করি, তাকেই আমার সন্তান মনে করি। ঝালকাঠির এমন কোনো পরিবার নেই যে তাদের সন্তানকে আমি দেখিনি, এই অঞ্চলে এমন সন্তান খুব কম।

সেবামূলক কাজে তার আয়ের একটি অংশ ব্যয় করছেন অকৃপণভাবে। স্কুলে বিজ্ঞানকক্ষ নির্মাণ, উপাসনালয়ে ভবন নির্মাণ, বিভিন্ন দিবসে ফ্রি চিকিৎসা ও ওষুধ বিতরণ এবং মানুষকে আর্থিক সহায়তাসহ বিভিন্নভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন মানুষের জন্য। গড়েছেন অসীমাঞ্জলী ফাউন্ডেশন। নিজের পেনশনের এককালীন ১৫ লাখ টাকা এই ফাউন্ডেশনে দান করেছেন, যার মাধ্যমে স্কুলের মেধাবীদের ও সমাজের বয়স্কদের সাহায্য করা যায়।

অসীমাঞ্জলী ফাউন্ডেশন থেকে এর আগেও নানা সেবামূলক কাজ করা হলেও ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও শিশু দিবস উপলক্ষে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এদিন ২০২ রোগীকে ডা. অসীম ফ্রি চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদান করেন।

শিশু ডিসিপ্লিনে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে ডা. অসীম জানান, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ইন্টার্ন করার সময় শিশু বিভাগের প্রধান আমার স্যার প্রফেসর ডা. আবদুর রবকে দেখেছি, তিনি কীভাবে একটি মৃতপ্রায় শিশুর মুখে শ্বাস দিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন। তখন তো এত আধুনিক চিকিৎসাযন্ত্র ছিল না। পরে স্যার ও আমি প্রায় এক মাস চিকিৎসা করে শিশুটিকে হাসিমুখে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিই। স্যারের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এরপর আমি শিশু ডিসিপ্লিনে আসার সিদ্ধান্ত নেই।

ডা. অসীম কুমার

গত ৩৪ বছরে চিকিৎসা করতে গিয়ে মানুষের বিচিত্র ভালোবাসা পেয়েছেন বলে জানান তিনি। কত শিশু সুস্থ হলে তাদের মায়েরা এই চিকিৎসকের কাছে কেঁদে ফেলেছেন, তা গুনে শেষ করা যাবে না। তাই চিকিৎসাসেবা ঠিক রেখেই তিনি অন্যান্য সামাজিক কাজ করতে চান।

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি তাকে এফআরসিপি (ফেলো অব দ্য রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জন) সম্মান প্রদান করে। সম্মানের স্বীকৃতিপত্র কয়েক মাস আগে অনলাইনে পেলেও ১১ মার্চ তার হাতে এসে পৌঁছেছে সনদ। যুক্তরাজ্যের এডিনবোরা ইউনিভার্সিটিও তাকে এই সম্মান দিতে চেয়েছিল।

ডা. অসীম সুইজারল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আন্তর্জাতিক সায়েন্টিফিক সেমিনার ও ওয়ার্কশপে অংশ নিয়েছেন।

১৯৯২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ডা. অসীম কুমার সাহা পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন অঞ্জলী রানী সাহাকে। ব্যক্তিজীবনে ডা. অসীম কুমার নিঃসন্তান। এবং ভাইদের সন্তানদেরই নিজের সন্তান হিসেবে মনে করেন তিনি।

এনএ