প্রায় দুই যুগ ধরে কুষ্টিয়া রেলওয়ে স্টেশন এলাকার ৩০টি পরিবার বন্দি জীবন পার করছে। চারপাশে সরকারি অফিসের সীমানা প্রাচীরে অবরুদ্ধ তারা। জীবন-জীবিকার তাগিদে তারা রেলওয়ের সীমানা প্রাচীরের সঙ্গে মই ব্যবহার করে বাইরে যাতায়াত করেন। মই বেয়ে প্রাচীর টপকাতে গিয়ে ঘটে দুর্ঘটনা। বৃদ্ধ, অন্তঃসত্ত্বা নারী, অসুস্থ রোগী ও শিশুরা বাইরে যাতায়াত করতে পারেন না। সরকারের কাছে চলাচলের রাস্তা চান তারা। 

স্থানীয় বাসিন্দা ডলিয়া খাতুন বলেন, মই পার হয়ে আসা-যাওয়া করতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। একজন মানুষ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে কষ্ট হয়। মানুষ মারা গেলে খাটিয়া বের করার পথটাও নেই। বর্ষাকালে জলাবদ্ধতায় হাঁটু পানি জমে থাকে। আমরা সরকারের কাছে রাস্তা চাই। 

বৃষ্টি খাতুন বলেন, আমরা চার দেয়ালে বন্দি, মনে হয় জেলখানার মধ্যে বসবাস করছি। আমার একটা প্রতিবন্ধী মেয়ে আছে, তাকে নিয়ে উঠানামা করতে হয়। শিশু, বৃদ্ধরা ও স্কুল শিক্ষার্থীরা যাতায়াত করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। মানুষ মারা গেলে খাটিয়া আনা-নেওয়া করা যায় না, কাঁধে করে মরদেহ পার করতে হয়। 

রাজু আহমেদ বলেন, প্রায় ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে চার দেওয়ালে বন্দি আমরা। বাড়িতে যাতায়াতের পথ নেই। আমরা মই ব্যবহার করে প্রাচীরের ওপর দিয়ে যাতায়াত করি। এভাবে চলতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। এভাবে যাতায়াত করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে। ছোটরা মই থেকে পড়ে যায়, হাত-পা ভেঙে যায়। প্রায় ৩০টি পরিবার এখানে বসবাস করি। আমাদের কষ্ট কারো চোখে পড়ে না। এই বন্দি অবস্থায় আর কত বছর থাকব? আমরা সরকারের কাছে রাস্তা চাই।

সরেজমিনে দেখা যায়, কুষ্টিয়া রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের বিপরীত দিকে প্রায় ৩০ পরিবার বসবাস করে। বাড়ি থেকে বাইরে যাতায়াতের কোনো পথ নেই। প্রয়োজন আর জীবন-জীবিকার তাগিদে তারা রেলওয়ের উঁচু প্রাচীরের সঙ্গে মই ব্যবহার করে বাইরে যাতায়াত করছেন। ৩০ পরিবার যে জায়গায় বসবাস করেন তার একপাশে থানা, একপাশে সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, একপাশে ইসলামিয়া কলেজ আর একপাশে রেলওয়ে স্টেশন। সরকারি অফিসগুলোতে সীমানা প্রাচীর দেওয়া। ফলে ৩০টি পরিবার চারপাশের দেয়ালে আটকা পড়েছেন। তাদের যাতায়াতের কোনো পথ নেই।   

বিউটি খাতুন বলেন, আমার পরিবার ভূমিহীন। মা-বাবা মারা গেছে। আমরা প্রায় ৩০-৪০ বছর ধরে এখানে বাস করছি। প্রায় ২০ বছর ধরে চার দেয়ালে আমরা বন্দি। যাতায়াতের কোনো রাস্তা নেই। আমরা মই বেয়ে রেলওয়ের দেয়াল টপকে চলাচল করি। এই যুগে আমাদের মতো এই কষ্ট আর কেউ করে না। আমাদের একটা রাস্তার খুবই দরকার। 

আমরা প্রায় দুই যুগ বন্দি অবস্থায় আছি। চারপাশে দেয়াল, থানা, রেলওয়ে, পৌরসভা ও রেজিস্ট্রার অফিসের দেয়ালে আমরা বন্দি। আমাদের মতো এমন পথের সমস্যা আর কোথাও নেই। দেয়াল টপকে চলাচল করতে কষ্ট হয়। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে গিয়ে পড়ে যায়, আহত হয়, হাত-পা ভেঙে যায়। আমরা আর পারছি না। সরকারের কাছে রাস্তার আবেদন করছি।

তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র আব্দুল্লাহ রহমান বলে, স্কুলে যাওয়ার সময় আমাদের খুব ভয় করে, কষ্ট হয়। মই বেয়ে উঁচু দেয়াল পার হতে গিয়ে অনেকে পড়ে যায়।  আপনারা সাহায্য করেন।

কুষ্টিয়া পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর খন্দকার মাজেদুল হক ধীমান বলেন, চারপাশে সরকারি অফিসের সীমানা প্রাচীরের ফলে তাদের যাতায়াতের পথ নেই। তারা রেলওয়ের দেয়ালের সঙ্গে মই ব্যবহার করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে যাতায়াত করে। তাদের পথের সমস্যা নিরসনের জন্য আমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তারা কোনো সিদ্ধান্ত দেয় না। তাদের নিরাপদ পথের ব্যবস্থা করা খুবই দরকার। 

কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাধন কুমার বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, রেলওয়ের জায়গায় তারা দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করেন। চারপাশে সরকারি অফিসের সীমানা প্রাচীর। ফলে তাদের বসবাস করার জায়গাটা আটকা পড়েছে, যাতায়াতের কোনো পথ নেই। সরকারি অফিসগুলো তাদের নিরাপত্তার জন্য দেয়াল দিয়েছে। তবুও আমি আমার জায়গা থেকে রেলওয়ে কর্তপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে পারি। তারা পথ দেবে কিনা, সেটা তাদের সিদ্ধান্ত।

রাজু আহমেদ/আরএআর