বেকারত্ব ঘুচিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে ফ্রিল্যান্সিং। সাধারণত ফ্রিল্যান্সারদের দেশের সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে ফ্রিল্যান্সিংয়ের আড়ালে কিছু তরুণ অবৈধ পন্থায় সিপিএ মার্কেটিং করছেন। ভিজিটর টানতে তারা ব্যবহার করছেন পর্নো ছবি বা ভিডিও।

ঠাকুরগাঁও জেলা শহর থেকে এমন কাজে সঙ্গে জড়িত চার ফ্রিল্যান্সারকে ২৯টি ল্যাপটপসহ আটক করেছে পুলিশ। গত রোববার (২ এপ্রিল) রাতে শহরের হাজিপাড়ায় মহিলা কলেজ সংলগ্ন একটি ভাড়া বাসায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়।

জানা গেছে, ঠাকুরগাঁও শহরের হাজিপাড়ায় মহিলা কলেজ সংলগ্ন একটি চার রুমের বাসা ভাড়া নেন সোহাগ নামে এক যুবক। সেখানে দক্ষ কিছু ফ্রিল্যান্সার নিয়ে অবৈধ পন্থায় সিপিএ মার্কেটিংয়ের কাজ শুরু করেন তিনি। তবে সম্ভাবনাময় এই কর্মক্ষেত্রকে ভুল দিকে পরিচলনা করেন সোহাগ।

এ বিষয়ে কথা হয় সোহাগের অফিসে কাজের সুবাদে বিপথগামী এক ফ্রিল্যান্সারের সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই যুবক জানান, সোহাগের অফিসে মূলত সিপিএ মার্কেটিংয়ের কাজ হতো। কৌশলী হলে এই পেশা থেকে প্রচুর টাকা আয় করা সম্ভব। তবে সোহাগ ও তার দল কৌশল হিসেবে কিছুটা অবৈধ পথ অবলম্বন করেছিল।

এই ফ্রিল্যান্সার জানান, সিপিএ অর্থ হচ্ছে কস্ট পার অ্যাকশন অর্থাৎ এখানে ছোট ছোট কিছু টাস্ক পূরণ করে দিতে হবে। যার বিনিময়ে আপনি কিছু কমিশন পাবেন। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে বা সাইটে আসা ভিজিটরদের সিপিএ মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে কোম্পানির নির্ধারিত সাইটে নিয়ে যাওয়াই হলো ফ্রিল্যান্সারদের কাজ। সিপিএ এমন একটি অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং, যেটার মাধ্যমে আপনি কোনো পণ্য বিক্রির পাশাপাশি ছোট কোনো কাজ যেমন ইমেইল সাবমিট বা ডাউনলোড ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে আয় করতে পারবেন। 

তিনি বলেন, ব্যবসায়িক সাইট বা কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য প্রচার বা সাইটের কোনো সার্ভে করতে সিপিএ মার্কেটিংয়ের শরণাপন্ন হয়। বিভিন্ন উপায়ে এসব কোম্পানির প্রমোশনাল কাজ সম্পন্ন করা হয়। সাধারণত যারা সিপিএ মার্কেটিং করে তাদের নিজস্ব সাইট থাকে। আমাদের সাইটে কোম্পানির নির্ধারিত লিংক অ্যাটাচ করা থাকে। এতে করে ভিজিটর সাইটের কোথাও ক্লিক করলে অ্যাটাচ করা সাইটে যেতে বাধ্য হয়। আর এই ক্লিক করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কাজ সম্পন্ন হয়। আমরা ক্লিকের বিনিময়ে টাকা পাই। 

সোহাগ জানান, ভিজিটরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পর্নো ছবি ও ছোটখাট পর্নো ফুটেজ ব্যবহার করতেন তিনি। ভিজিটররা সেই পর্নো ছবি বা ভিডিও দেখতে ক্লিক করলেই অ্যাটাচ করা সাইটে চলে যেত। এতে করে বেশি পরিমাণ ক্লিক পাওয়া যেত। বিশেষ করে টিনেজরা তাদের ফাঁদে পড়ত। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ডেটিং সাইটসহ বিভিন্নভাবে ভিজিটর আকর্ষণের চেষ্টা করতেন। যেহেতু এসব কৌশল গোপনীয়, সর্ব সম্মুখে প্রকাশ করার মতো নয়। তাই মুখবন্ধ রাখতে এখানে চাকরিরতরা বেশি বেতন পান। 

অন্য ফ্রিল্যান্সার শামীম উজ্জামান বলেন, এভাবে আমরা ভিজিটরদের ধোঁকা দিচ্ছি। সেই সঙ্গে কিন্তু বায়ার কোম্পানিকেও ধোঁকা দিচ্ছি। কারণ কোম্পানি কখনো এ সব অপ্রয়োজনীয় ভিজিটর চায় না। তারা পণ্যের আগ্রহী ভিজিটর খোঁজেন। এভাবে ভুয়া ভিজিটর অব্যাহত রাখলে বিদেশি কোম্পানিগুলো আমাদের দেশের ফ্রিল্যান্সারদের ওপর থেকে বিশ্বাস হারাবে। আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে নেবে।

ফ্রিল্যান্সারদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (বিএফডিএস) ঠাকুরগাঁও জেলা কমিটির সভাপতি শাহিন সালেহিন বলেন, হাজিপাড়ায় ঘটে যাওয়া বিষয়টি জেনেছি। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তারা অবৈধ পন্থা অবলম্বন করেছিল। সোহাগ নামের সেই ফ্রিল্যান্সারকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তিনি আমাদের সংগঠনের সদস্য না। তবে গোপনে আমাদের সংগঠনের বেশ কিছু সদস্য সেই অফিসের সঙ্গে জড়িয়েছিল। সেখানে জড়িতরা আমাদের সংগঠন থেকে অবশ্যই বহিষ্কার হবে। কারণ কোনো বেআইনি কাজকে আমরা প্রশ্রয় দিতে চাই না।

বিএফডিএসের চেয়ারম্যান ড. তানজীবা রহমান বলেন, দেশে এখন সাত থেকে আট লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছে। সব বয়সী মানুষ এখন যুক্ত হচ্ছেন ফ্রিল্যান্সিং কাজের সঙ্গে। গ্রাফিক্স ডিজাইন, থ্রিডি, টুডি মডেলিংসহ বিভিন্ন ধরনের শতাধিক কাজের মধ্যে থেকে বেছে নিচ্ছেন পছন্দ ও দক্ষতা অনুযায়ী অনলাইন টাস্ক। ফ্রিল্যান্সারদের জন্যে কাজের অনেক সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে আমরা যেন কেউ ভুল পথে পা না বাড়াই সেদিকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। যারা এসব কাজের সঙ্গে জড়াচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনতে আমরা সরকারের সঙ্গে এক যোগে কাজ করছি। আশা করি দ্রুতই চিহ্নিত করে এদের নির্মূল করা সম্ভব হবে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঠাকুরগাঁও সদর থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) জবেদ জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মহিলা কলেজ সংলগ্ন বাসাটিতে পুলিশ অভিযান চালায়। সেখানে থাকা ২৯টি ল্যাপটপ যাচাই করে পর্নোগ্রাফি ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। পরে আটককৃত চারজনও নিজেদের দোষ স্বীকার করেছে। পর্নোগ্রাফি আইনে নাম ঠিকানাসহ ২৫ জন ও কিছু অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করেছি। এর সঙ্গে যুক্ত থাকা সকল পলাতক আসামিকে আইনের আওতায় আনতে পুলিশ কাজ করছে।

আরকে/আরএআর